আম্বুয়ামুলুকে

সৌনিপ সোম


~ কালনার তথ্য ~ কালনার আরও ছবি ~

।। ১ ।।
: যাত্রা শুরু:-

কথায় বলে কালে পাওয়া। আমাদের হয়েছিল তাই। কালনা যাওয়াটা কোনও না কোনও কারণে কাল কাল করে পিছিয়েই যাচ্ছিল। পরিকল্পনা অনেকদিনের, কিন্তু সেই কাল আর আসছিল না। অবশেষে ২৬ ডিসেম্বর সকালে "আর কাল না, আজই যাব কালনা" বলে রওনা হলাম। সঙ্গী দুই বন্ধু শান্তনু আর সৈকত। সেই তীর্থপথের গল্পই আজ করব, কাজেই আর কালহরণ কেন?

জেলা সদর বর্ধমান থেকে ৬০ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে, গঙ্গার দক্ষিণ তীরে মহকুমা শহর অম্বিকা-কালনা। ব্যাণ্ডেল কাটোয়া শাখায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনও বটে। ট্রেন যায় হাওড়া, শিয়ালদহ ও ব্যাণ্ডেল থেকে। রওনা হয়েছিলাম সকালের হাওড়া-কাটোয়া লোকালে। ট্রেনে আসতে আসতে সৈকত জিজ্ঞাসা করেছিল, হঠাৎ কালনা কেন? বড় কঠিন প্রশ্ন। বলা যায় বাংলার একান্ত নিজস্ব স্থাপত্যশৈলীর স্বাদ নিতে। রেখদেউল, রত্ন, চালা, দালান, জোড়বাংলা - গৌড়ীয় স্থাপত্যধারার প্রায় সব শৈলীর মন্দিরের একত্র সমাবেশ বাংলার যে কটা জায়গায় আছে কালনা তার মধ্যে অন্যতম। একসময় বর্ধমান রাজপরিবারের সদস্যেরা গঙ্গাস্নান করতে আসতেন এখানে। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে যখন রাজপরিবারের গৌরবরবি মধ্যগগনে, তখন তাঁরা এ শহরটি সাজিয়েছেন মন্দিরে মন্দিরে। তবে এ শহরের ঐতিহ্য আরও প্রাচীন। বৈষ্ণব-শাক্ত গঙ্গাযমুনার মিলনস্থল এই শহর যেমন শ্রীচৈতন্য ও প্রভু নিত্যানন্দের পদধূলিধন্য বৈষ্ণব শ্রীপাট, তেমনই মা সিদ্ধেশ্বরীর শক্তিপীঠও। কালনার ইসলামীয় স্থাপত্যও একসময় ছিল নজর কাড়ার মত।

কালনা পৌঁছলাম নটা নাগাদ। স্টেশনের বাইরে এসে দেখি সারি দিয়ে রিক্সা আর টোটো যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। সবাই হাঁকছে শহরের বিভিন্ন প্রান্তের নাম ধরে। তার পাশেই সারি সারি ভোজনালয়। বেতের ঝাঁকা থেকে হাতছানি দিচ্ছে সদ্যভাজা পরোটা-কচুরির দল। ভাজার গন্ধে ম ম করছে জায়গাটা। খালিপেটে খিদেটাও যেন চাগাড় দিয়ে উঠল। তাই যাওয়ার পথে এদের সদ্ব্যবহার করে যাওয়াই স্থির হল। শান্তনুর মতে এই মুমুক্ষু পরোটাগুলোকে উদ্ধার করে না গেলে তীর্থদর্শনের পুণ্য সম্পূর্ণ হত না। তাছাড়া দোকান থেকে কিছু খোঁজখবরও পাওয়া যাবে এই আশায় এগিয়ে গেলাম।

ভিড় কাটিয়ে হাজির হলাম একটা হোটেলে। হোটেলের নাম মনে নেই, তবে মালিক গণেশদাকে মনে আছে এবং থাকবেও। ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ না হলে কালনা দর্শন কেমন হত জানিনা। হয়তো এত সুন্দর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে পারতাম না। গণেশদাকে জানালাম আমাদের আসার উদ্দেশ্য এবং জানতে চাইলাম উদ্দেশ্যসাধনের বিধেয়। কিছুটা দূরে একজন ফোনে কথা বলছিলেন। তাকে দেখিয়ে গণেশদা বললেন, ওই জগন্নাথ। এখনই আসবে টিফিন করতে। ওর টোটো আছে, ওকেই বল, সব ভালো করে দেখিয়ে দেবে। ছেলে ভালো, সব গাইডও করে দেবে। একটু থেমে গলাটা নামিয়ে বললেন, ৪০০-৪৫০ টাকা চাইবে, তোমরা ৩০০ থেকে শুরু কোরো। ৩৫০টা ঠিকঠাক রেট। পরোটাগুলো ঝুড়িতে চালান দিয়ে বললেন, রেটের ব্যাপারে আমার কথা কিছু বোলনা যেন - আমাদের তরফ থেকে ব্যাপারটা ঠিক ম্যানেজ করে নেওয়ার আশ্বাস পেয়ে প্লেটে ঘুগনি তুলতে মন দিলেন গণেশদা।

ফোন করা শেষ হলে জগন্নাথ এল টিফিন করতে। আমাদের সমবয়সীই। খেতে খেতেই কথা পাড়লাম। ৩৫০ টাকায় রফা হল। সব ঘুরিয়ে এখানেই নামাবে, গণেশদার হোটেলে দুপুরের ভাত খেয়ে কালনা দর্শন সমাপ্ত করব, এইরকম ঠিক হল। মন্দির প্রাঙ্গণ স্টেশন থেকে টোটোতে দশ মিনিটের পথ। পথ গেছে শহর কালনার মাঝখান দিয়ে। নগরদেবী অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরীর নামে স্থানটির নাম অম্বিকা কালনা বা অম্বিকানগর। আর বৈষ্ণব পদাবলীতে পরিচিতি আঁবুয়া বা আম্বুয়া নামে। মঙ্গলকাব্যেও পাওয়া যায় "পুরী আম্বুয়ামুলুক", "সহর আম্বুয়ামুলুক" প্রভৃতি। সেসব ইতিহাসের ওপর আজকের কালনা সেজে উঠেছে পুরোদস্তুর আধুনিকতার মোড়কে। শুনতে পেলাম সামনেই কালনা পর্যটন উৎসব তাই মন্দির প্রাঙ্গণের পাশের মাঠ সেজে উঠছে। অস্বীকার করবনা, একটু ভয় পেয়েছিলাম, যাদের জন্যে আসা, তাদের স্বমহিমায় পাব তো?

।। ২ ।।
-: রাজবাটীর মন্দির প্রাঙ্গণ:-

পৌঁছলাম প্রথম গন্তব্যে, কালনার মন্দির প্রাঙ্গণে। বর্ধমানরাজের রাজবাটীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই বিশাল প্রাঙ্গণ – ছটি মন্দির ও রাসমঞ্চ নিয়ে। প্রাঙ্গণের বেশিরভাগ মন্দিরেরই পৃষ্ঠপোষক রাজ পরিবারের রাণী বা রাজমাতা। বৃহৎ তোরণ পেরিয়ে মন্দিররাজ্যে প্রবেশ করা মাত্র সময় যেন পিছিয়ে যায় কয়েকশো বছর। পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের তত্ত্বাবধানে সাজানো উদ্যানের মাঝে ছড়িয়ে থাকা মন্দিরগুলি সে যুগের কথাই মনে করায়। তবে চারদিকে চোখ বোলাতে গিয়ে যখন দাম্ভিক বহুতলে কিম্বা চলভাষের গগনভেদী স্তম্ভে দৃষ্টি আটকা পড়ে, হঠাৎ করে ফিরে আসতে হয় বর্তমানে। আধুনিকতার মাঝে মন্দিরগুলি বেমানান, না প্রাচীন মন্দিরের দৃশ্যপটে ওগুলি দৃশ্যদূষণ, সে প্রশ্ন বাদ দিয়ে ডুব দিই আমাদের ঐতিহ্যের খোঁজে।

ছবি তোলার দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছিলাম। প্রতিটি মন্দিরের সামনেই মন্দির সম্বন্ধে লেখা একটি করে ফলক চোখে পড়ল। শান্তনুর ভাগে পড়ল ওই ফলকের ছবি ধরে রাখার দায়িত্ব। ও সযত্নে দায়িত্ব পালন করেছিল বলে আজ আমার কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে। সৈকত মন্দিরের ছবি তোলার পাশাপাশি অজান্তে আমাদের কিছু বিশেষ ছবি তুলে রেখেছিল। দুঃখের বিষয়, ওর চলভাষ কোনও কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে মুছে দিয়েছিল সেই সমস্ত স্মৃতিচিহ্ণ। আর আমার ভাগে ছিল ল্যান্ডস্কেপ আর টেরাকোটা প্যানেলের দায়িত্ব। জগন্নাথও এসেছিল, তবে আমাদের সঙ্গে ঘোরেনি। কোনটা কী মন্দির চিনিয়ে দিয়ে ফিরে গেছিল নিজেদের আড্ডায়। আমরা এক এক করে দেখতে থাকি।

প্রাঙ্গণে প্রবেশের পর প্রথমেই বাঁদিকে জলেশ্বরের বা প্রতাপেশ্বরের দেউল। নাতিউচ্চ বেদীর ওপর রেখদেউল শৈলীর পূর্বমুখী শিব মন্দিরটি নির্মাণ করেন প্যারীকুমারী, ১৮৪৯ খৃষ্টাব্দে বা ১৭৭১ শকাব্দে। ভিতরে আছে জলেশ্বর শিবলিঙ্গ। তবে এই মন্দিরের বিশেষত্ব, এর গা ভর্তি চোখজুড়োনো পোড়ামাটির কাজ। রাধাকৃষ্ণ, রামসীতা, ব্রহ্মা, গণেশ, দুর্গামূর্তি ছাড়াও পোড়ামাটির ফলকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দেড়শো বছর আগের সমাজচিত্র – তৎকালীন বাঙালি বাবু, গৃহিণী, সাহেব-মেম, সাপুড়ে, সৈনিক, ঘোড়সওয়ার, কীর্তন, পুজার উৎসব, হোলি প্রভৃতি। দেখে ভালো লাগল, মন্দিরটি যথাযথভাবে সংরক্ষিত।

প্রতাপেশ্বর দেউলের পাশে অষ্টভূজাকৃতি রাসমঞ্চ। অষ্টভূজের মাঝে গম্বুজাকৃতির মঞ্চ। এটি লালজী মন্দিরের লালজীউর রাসমঞ্চ। সাধারণতঃ এই আকৃতির রাসমঞ্চ বিরল।

রাসমঞ্চের পরই লালজীবাড়ির দরজা। প্রাঙ্গণের মধ্যে পৃথক পাঁচিলে ঘেরা লালজীবাড়ি এখানকার সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির। অতিবৃহৎ পঞ্চবিংশতিরত্ন মন্দির পশ্চিমবাংলায় খুব কমই আছে, তার মধ্যে তিনটি কালনায়, তার দুটি এই প্রাঙ্গণেই। লালজী মন্দির তার মধ্যে একটি। অন্যটার কথায় পরে আসছি। মহারাজ কীর্তিচন্দ্রের রাজত্বকালে ১৭৩৯-৪০ খৃষ্টাব্দে (১৬৬১ শকাব্দে) মন্দিরটি নির্মিত হয়। মন্দিরের সামনে বৃহৎ চারচালা নাটমন্দির রয়েছে যা গিরিগোবর্ধন নামে পরিচিত, এর মধ্যে রয়েছে গরুড় স্তম্ভ।
লালজীবাড়ি নাম শুনে মনে হয়েছিল কৃষ্ণের গোপাল মূর্তি দেখতে পাব গর্ভগৃহে। কিন্তু না, গর্ভগৃহের সিংহাসনে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির অবস্থান। অপূর্ব মন্দিরের গঠনরীতি আর পোড়ামাটির কাজ। যুদ্ধযাত্রা, শিকার, পালকিবহন, বরযাত্রী, মা ও শিশু প্রভৃতি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ফুটে উঠেছে মন্দিরগাত্রের ফলকে ফলকে। লালজীবাড়ির মধ্যেই রয়েছে দালানরীতির নারায়ণ মন্দির। একশো আটটি নারায়ণ শিলার নিত্যপুজো হয় এখানে।

লালজী বাড়ির দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে রূপকুমারী প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণমুখী রূপেশ্বর শিবমন্দির। এটি দালান শৈলীর। আর এর সামনেই বাংলার আটচালারীতিতে নির্মিত ছোট ও মাঝারি পাঁচটি শিব মন্দির রয়েছে। এগুলি পঞ্চরত্ন শিবমন্দির নামে খ্যাত।

এই প্রাঙ্গণের অন্য পঞ্চবিংশতিরত্ন মন্দিরটি কৃষ্ণচন্দ্রজীউর মন্দির। প্রতিষ্ঠাকাল ১১৫৯ বঙ্গাব্দ (১৭৫২ খৃঃ)। দক্ষিণমুখী মন্দিরটির সামনে দোচালা নাটমন্দির। গর্ভগৃহে রাধাবল্লভ অধিষ্ঠিত। পোড়ামাটির অলংকরণে এই মন্দিরটিও কিছু কম নয়। প্রতিদিনকার বিভিন্ন খণ্ডচিত্রের পাশাপাশি ফলকে রয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। কৃষ্ণচন্দ্রজীউ মন্দিরটির সামনে দক্ষিণমুখী হয়ে দাঁড়ালে ডানদিকে পড়বে বদ্রীনারায়ণ মন্দির, বামে রামসীতা মন্দির ও সামনে রাধাবল্লভ মন্দির। এই তিনটি মন্দিরই দালান শৈলীর। আর মন্দিরের পিছনে রয়েছে বৃহৎ আটচালা শৈলীর বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দির। এই মন্দিরটির গায়ে পোড়ামাটির অলংকার তুলনামূলকভাবে কম।

প্রাঙ্গণের সব মন্দির দেখা শেষ করে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ফিরতে হল। আমাদের তিনজনের একসঙ্গে একটাও ছবি তোলা হয়নি যে! সৈকতের নেতৃত্বে দু-তিনটে নিজস্বী তুলে মূল তোরণ দিয়ে বেরিয়েই জগন্নাথদর্শন। চিন্তিত মুখে অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল। আমাদের দেখে বলল, আরও অনেক কিছু এখনও দেখা বাকি। ভাবখানা এই, একটু তাড়াতাড়ি কর, এক জায়গায় এতক্ষণ থাকলে আমার তো চলবেনা। পরেরগুলো তাড়াতাড়ি দেখে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে গেলাম রাস্তার ঠিক অপর পারে একশো আট শিবমন্দির বা নবকৈলাশ মন্দিরে।

তীর্থনগরী কালনার গলায় রুদ্রাক্ষের মালার মতো জড়ানো নবকৈলাশ মন্দির। ১৭৩১ শকাব্দে (১৮০৯ খৃঃ) মহারাজ তেজচন্দ্রের রাজত্বকালে মন্দিরগুলি তৈরি হয়। একশো আটটি মাঝারি আকারের আটচালা শিব মন্দির সাজানো দুটি সমকেন্দ্রিক বৃত্তাকারে, ভিতরের বৃত্তে চৌত্রিশটা এবং বাইরের বৃত্তে চুয়াত্তরটা মন্দির। প্রবেশদ্বারগুলিও আটচালা শৈলীর। তবে মন্দিরগাত্রে অলংকরণ এখানে নেই। বহির্বৃত্তের মন্দিরগুলিতে একটিতে কৃষ্ণপ্রস্তরের, পরেরটিতে শ্বেতপ্রস্তরের এই বিন্যাসে শিবলিঙ্গ আছে। আর অন্তর্বৃত্তে সবকটিই সাদা পাথরের। একদম কেন্দ্রস্থলে একটি কূপ, সম্ভবতঃ মন্দিরের প্রয়োজনীয় জল তোলার জন্যে। পরে জেনেছি, মন্দিরের সংখ্যা একশো আট না, নয়। শেষ এই মন্দিরটি আলাদাভাবে বাইরে অবস্থিত।

।। ৩ ।।
-: শ্রীপাট কালনা:-

টোটোয় উঠে জিজ্ঞাসা করলাম পরবর্তী গন্তব্যের ব্যাপারে। উত্তর পেলাম নিত্যানন্দ প্রভুর বিবাহমন্ডপ। খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম। প্রবেশদ্বারের গায়ে ফলকে লেখা শ্রীশ্রীশ্যামসুন্দর নিতাই গৌরের শ্রীমন্দির। নাটমণ্ডপ সমেত মন্দির, সামনে একটা বাঁধানো জায়গা রয়েছে। তার মাঝে একটি কুলগাছ। শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর অন্তরঙ্গ পার্ষদ নিত্যানন্দ প্রভুকে গার্হস্থ্য জীবনযাপনের আদেশ দিলে তিনি শালিগ্রামনিবাসী সুর্যদাস পণ্ডিতের দুই কন্যা বসুধা ও জাহ্নবীদেবীকে বিবাহ করেন এখানেই। ছাদনাতলায় ব্যবহৃত শীলটি এখনও আছে। বিবাহের পর নিত্যানন্দ প্রভু ঘর বাঁধেন খড়দহে, সেখানেও আছে আর এক শ্রীপাট। তাঁর পুত্র বীরভদ্র শুনতে পাই আমাদের শ্রীরামপুরের বল্লভপুরে এসেছিলেন রাধাবল্লভ মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে।

প্রতি বছর মাঘ মাসের শুক্ল একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত এখানে উৎসব হয়। নামকীর্তন হয়। ঐ সময়ে নিত্যানন্দপ্রভুর জন্মতিথি, জানায় জগন্নাথ।

এরপর কালনা কালীবাড়ি বা ভবাপাগলার কালীবাড়ি হয়ে এগিয়ে যাই সুর্যদাস বাবাজীর অনুজ গৌরীদাস বাবাজীর পাটবাড়ি বা মহাপ্রভুর বাড়ির পথে। কালীবাড়ির কথায় পরে আসছি।

১৫১৩ খৃষ্টাব্দে মহাপ্রভু যখন নীলাচল থেকে শান্তিপুর আসেন, গৌর-গৌরীদাস সাক্ষাৎ হয় কালনাতে। আমরা যখন পৌঁছাই মন্দির তখন বন্ধ। দেবতার ভোগপর্ব চলছে। পুরোহিতস্থানীয় একজন জানালেন, একটু অপেক্ষা করতে, কিছুক্ষণের জন্যে একবার দরজা খোলা হবে। তখন দর্শন পাওয়া যাবে। পাটবাড়ির মন্দিরটি দালান শৈলীর, দক্ষিণমুখী। সামনে নাটমন্দির। জগন্নাথের কাছে শুনলাম, মন্দিরে পাঁচটা ঘরে অনেক দেবতার অধিষ্ঠান। নিত্য ভোগ হয়, আগে থেকে জানিয়ে রাখলে ভোগ পাওয়াও যায়। এখানেও নিত্যানন্দপ্রভুর জন্মতিথিতে অর্থাৎ মাঘী পূর্ণিমার সময়ে উৎসব হয়। এইসব কথার মাঝেই দেখি পুরোহিত মশাই মন্দিরদ্বার খুলে দিয়েছেন। প্রথমে খোলা হয়েছে সর্ববামের দরজা। ভিতরে অধিষ্ঠিত রাধাগোবিন্দ, মহাদেব, রামলক্ষ্মণ, লক্ষ্মীনারায়ণ এবং গৌরীদাস পণ্ডিত স্বয়ং। এর পরেরগুলিতে রয়েছেন, গোপাল, গৌরনিতাই, রামসীতা, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা প্রমুখ। দরজা খোলা হয়েছিল কয়েক পলের জন্য। দর্শন সেরে দেবতাকে প্রণাম করে ফিরে এসেছিলাম।

কালনা দেখে ফিরে আসার পরে নরহরি চক্রবর্তীর একটি পয়ার খুঁজে পাইঃ-"প্রভুদত্ত গীতা বৈঠা প্রভু সন্নিধানে। অদ্যাপিহ অম্বিকায় দেখে ভাগ্যবানে।।" মহাপ্রভুর স্বহস্তের অক্ষরে লেখা গীতা তিনি দিয়েছিলেন গৌরীদাস পণ্ডিতকে এবং সেই গীতা এখনও রাখা আছে এখানে। আর আছে মহাপ্রভুর ব্যবহৃত বৈঠা। দুর্ভাগ্য সেসব দর্শনে বঞ্চিত হলাম। জানিনা সকলের সামনে সেই পবিত্র পুঁথি তাঁরা দেখাতে রাজি হতেন কিনা। যাই হোক, জানা থাকলে একবার চেষ্টা করে দেখতাম।

এরপর পাটবাড়ি থেকে গঙ্গার তীরে পাথুরিয়া মহল ঘাট হয়ে পাতালগঙ্গা। এই ঘাটটি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর সাজানো গোছানো। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে নিতে জগন্নাথের কাছে শুনলাম পাতালগঙ্গার কথা, সাধক ভগবানদাস বাবাজী ও তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার কথা। সাধক তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাবলে সশরীরে কালনায় বসে বৃন্দাবনে তুলসীগাছে মুখ দেওয়া ছাগল তাড়িয়েছিলেন এবং ঘটনার সত্যতার প্রমাণও দিয়েছিলেন বর্ধমানের মহারাজকে। শেষ বয়সে যখন তিনি গঙ্গাস্নানে যেতে অপারগ ছিলেন, তখন স্বগৃহে একটি কূপ খনন করান, তাঁর মন্ত্রবলে সেই কূপের জলে মা গঙ্গার আবির্ভাব হত, সেটাই পাতালগঙ্গা।

মিঠেকড়া রোদে বসে প্রবহমান গঙ্গা আর প্রাণচঞ্চল ঘাটে লোকজনের ব্যস্ততা দেখতে দেখতে পুরনো দিনের গল্প শুনতে বেশ ভালোই লাগছিল, কিন্তু ঘড়ি দেখে উঠে পড়তে হল। বেলা অনেক হয়েছে। ঘাট থেকে একটু ভিতরে গলিপথে পাতালগঙ্গা, নামব্রহ্মের পাট। এখানে নির্মাণকাজ চলছে, হয়তো কিছুদিন পরেই পাট চাপা পড়বে ফ্ল্যাটের আড়ালে। একটি কামরাঙা গাছের নীচে সাধকের সমাধি রয়েছে। পাশেই পাতালগঙ্গার কূপ। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে। কূপটি রাস্তার সমতল থেকে বেশ খানিকটা গভীর। পল্লবগ্রাহিতার এই এক দোষ। না হতে পেরেছি পুরোপুরি যুক্তিবাদী, না বিশ্বাসী। বিশ্বাসী হলে বিশ্বাস করতাম সাধকের অলৌকিকত্বে, মন্ত্রবলে গঙ্গা আনয়নকে। আর যুক্তিবাদী হলে আবিষ্কার করতে পারতাম গঙ্গা আনয়নের প্রকৃত রহস্য। বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত যুক্তি জানাল, কোনও সুড়ঙ্গপথে গঙ্গার সঙ্গে যোগ আছে এই কূপের। পাল্টা প্রশ্ন করল বিশ্বাস, মাটির গভীরে টানেল তৈরি করে গঙ্গাজল আনার প্রযুক্তি কি তখন এতটা উন্নত ছিল? এর কোনও মীমাংসা নেই আমার কাছে।

।। ৪ ।।
-: অম্বিকার নগর:-

দুই ভাইয়ের পাটবাড়ির মাঝে কালনা কালীবাড়ি। ভবাপাগলার কালীবাড়ি। ভবা পাগলার নাম শুনে শান্তনু জগন্নাথকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ইনি কি "নদীভরা ঢেউ, বোঝোনা তো কেউ...." গানটির রচয়িতা সাধক ভবা? উনি তো ঢাকার লোক শুনেছি। উত্তরে জানতে পারলাম ঢাকায় জন্ম হলেও তিনি তাঁর জীবনতরী এখানে বইয়েছিলেন। পুকুরপাড় দিয়ে গিয়ে ডান দিকে ভবার ভবরাণী মন্দিরের প্রবেশ পথ, আর বামে ভবার পবনপুত্র মন্দির আর ভবার হিমালয় – মাউন্ট এভারেস্ট। যেন শিশুর খেলাঘর। নামে কালীবাড়ি, তবু সব দেবতারই অধিষ্ঠান এখানে। সাধক ভবার হৃদয়ের সার্থক প্রতিচ্ছবি, যেখানে কালী, শিব, কৃষ্ণ, আল্লা মিলেমিশে এক হয়ে অবস্থান করেন। গর্ভগৃহে বেদীর ওপর "ভবার ভবানী" মূর্তি। পাশে রাধাকৃষ্ণ ও স্বয়ং ভবার মূর্তি। বাড়িটি সাজানো হয়েছে তাঁরই লেখা বিভিন্ন গানের পংক্তি দিয়ে। সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন গুণীজনের সঙ্গে তাঁর ছবি - শিশুর মতো সরল সদাহাস্যময়। এই গুণীজনের তালিকায় রয়েছেন উত্তমকুমারও। ভবানীর আশীর্বাদ নিয়ে পাগল ঠাকুরের আপন খেয়ালে সাজানো ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঠোনের গাছতলায় বসলাম, সঙ্গে নিয়ে এলাম তাঁর মহাপ্রসাদ – এক্লেয়ারস্ টফি। শান্তনুর দেখা তখনও শেষ হয়নি। এক গানপাগলের সৃষ্টির মধ্যে নিজের মনের খোরাক পেয়েছে আর এক গানপাগল, তাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখছে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এল ভবার কীর্তনের কলি গুনগুন করতে করতে, "...আমার আশা ছিল মনে মনে, যাব আমি বৃন্দাবনে, ভবা পাগলা রয় বাঁধনে মায়ার কাছে রে..."

কোনও এক বিশেষজ্ঞ (তাঁর নাম মনে নেই সেজন্য আমি তাঁর কাছে এবং বর্তমান পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী) বাংলার মন্দির-স্থাপত্য ধ্বংস হওয়ার দুটি কারণ নির্দেশ করেছিলেন: এক, সংস্কারের অভাব আর দুই, সংস্কারের আতিশয্য। অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে এসে চাক্ষুষ করলাম সংস্কারের আতিশয্যের বিধ্বংসীরূপ। জোড়বাংলা শৈলীর মাতৃমন্দির ও পাশে চারটি আটচালা শিবমন্দির সবকটাই উগ্র লাল, নীল, সবুজ, কমলা - নানা রঙে রঙিন! নেই সেই প্রাচীনত্বের আবেদন, যেটা এতক্ষণ পেয়ে এসেছি অন্য মন্দিরগুলোয়। পোড়ামাটির অলংকরণ কিছু আছে, কিন্তু রঙের প্রলেপে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। থেকেও না থাকার মতো।

অন্যান্য জোড়বাংলা মন্দিরের মতো প্রথম দোচালাটি অলিন্দ আর দ্বিতীয়টি গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহে শিবারূঢ়া মা সিদ্ধেশ্বরী। চতুর্ভুজা, লোলজীহ্বা। প্রণাম করে মন্দিরের পুরোহিত মশাইয়ের কাছ থেকে প্রসাদ নিলাম। তাঁর কাছে জানতে পারলাম মন্দিরের ইতিহাস। বিভিন্ন তান্ত্রিকগ্রন্থে সিদ্ধপীঠ হিসাবে কালনার সিদ্ধেশ্বরীর উল্লেখ আছে। পুরাকালে ঋষি অম্বরীশ এখানে এক পুকুরের ধারে বটগাছের নিচে একটি পাথরের ঘট পান। তিনিই ওই ঘট প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমান মন্দিরের স্থানে। হতে পারে, অম্বরীশই প্রাকৃতজনের মুখে হয়েছে আম্বুয়া। অম্বরীশের অধস্তন সাধক ঈশ্বরীশ স্বপ্নাদেশ পেয়ে অধুনাপূজিতা মাতৃমূর্তি নির্মাণ করান। কেউ কেউ মনে করেন ইনি প্রাচীন জৈন দেবী অম্বিকা। মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ ফলকে দেখালেন বর্তমান মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা চিত্রসেন রায়ের নাম। বর্তমান মন্দিরটি তৈরী হয় ১৬৬১ শকে (১৭৩৯ খৃঃ)। তবে রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গলে (সম্ভবতঃ পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে লেখা) আছে, "তোমার মহিমা মাতা কি বলিতে পারি। আম্বুয়ার ঘাটে বন্দো কালীকা ঈশ্বরী।।"অর্থাৎ "আম্বুয়া"-র "কালীকা ঈশ্বরী" আরও প্রাচীন। জগন্নাথের কাছে শুনলাম, একসময়ে এই মন্দিরে নরবলি হত, আজও তার বিকল্প হিসাবে ডাব বলি দেওয়া হয়। একসময় নাকি ডাকাতের দল রাতের অন্ধকারে নরমুন্ড দিয়ে মায়ের আরাধনা করে যেত।

।। ৫ ।।
-: সমাপ্তি:-

অম্বিকাদর্শন দিয়েই কালনা দর্শনের ইতি টানা হল। এবার ফেরার পালা। এগিয়ে চললাম স্টেশনের পথে। সময়ের চক্রান্তে বাকি থেকে গেল গোপালজীর পঞ্চবিংশতিরত্ন মন্দির, শাঁসপুরের প্রাচীন মসজিদগুলি, গুপ্তিপাড়ার মঠ, বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির এবং আরও অনেক কিছু। জানি আবার ফিরে আসতে হবে। অপেক্ষা শুধু তীর্থের দেবতার ডাকের। আবার কোনও শীতের সকালে হয়তো গণেশদার হোটেল থেকেই শুরু হবে নতুন করে পুরাতনের খোঁজ, হয়তো সেবারও সঙ্গী হবে জগন্নাথ।

~ কালনার তথ্য ~ কালনার আরও ছবি ~


সৌনিপ সোম পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী, নেশায় প্রকৃতির পাঠশালার ছাত্র। স্বভাব - সময় সুযোগ পেলেই অভিযান - প্রকৃতিকে ফ্রেমে বাঁধতে কিম্বা রাঢ়বাংলার আনাচে-কানাচে ইতিহাসের অলিগলিতে প্রাচীনত্বের সন্ধানে। আর বছরে অন্ততঃ একবার পদাতিকের বন্ধুদের সঙ্গে বিরাট হিমালয়ের কোনও এক নিভৃত অঙ্গনে কয়েকদিন কাটানোটা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এর বাইরে আছে বইয়ের জগৎ।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher