ম্যাজিক্যাল মংলাজোড়ি

পলাশ পান্ডা


~ মংলাজোড়ির আরও ছবি ~

এবারের গন্তব্য মংলাজোড়ি। ওড়িশার খুরদা জেলায়। শীতের কয়েকটা মাস এখানের জলাভূমিতে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি ভিড় করে, যদিও সারা বছরই এখানে পাখিদের দেখা মেলে। দূরে ছোট ছোট টিলা, টিলার কোলে আদিবাসী ধীবরদের বসতি, বিস্তীর্ণ জলাভূমি, ঘন নলখাগড়া ও হোগলার বন – এই নিয়েই চিলকার উত্তর-পশ্চিমে পাখিদের স্বর্গরাজ্য মংলাজোড়ি। মংলাজোড়ি ওয়েটল্যান্ড প্রায় ৭০ বর্গকিমি বিস্তৃত। জলের গভীরতা কোথাও ৪ মিঃ তো কোথাও ১ মিঃ। অসংখ্য খাঁড়ি ছড়িয়ে রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে ছোট ছোট নৌকা চলাচল করে।

মংলাজোড়িতে পাখি দেখতে গেলে হাতে অন্তত দিন দুই সময় রাখা দরকার, কিন্তু এক দিনই সময় বের করতে পারলাম আর বেরিয়ে পড়লাম পাখিদের স্বর্গরাজ্যের উদ্দেশ্যে। ২১ জানুয়ারি আমি ও আমার এক মাস্টারমশায় বন্ধু হলদিয়া থেকে লোকাল ট্রেনে খড়্গপুরে এসে বিকেল সাড়ে চারটের করোমন্ডল এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম- গন্তব্য ভুবনেশ্বর। প্ল্যানটা একটু আলাদা ভাবে করেছিলাম। মংলাজোড়িতে থাকাটা একটু খরচের হওয়ার জন্য আমরা ওখানে না থেকে ৭০ কিমি দূরে ভুবনেশ্বরে রাত্রিবাস করার পরিকল্পনা করি। ট্রেন ঘণ্টাখানেক লেট করায় ভুবনেশ্বরে পৌঁছতে রাত্রি প্রায় এগারটা হয়ে গেল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে ওখানেই রাতের খাওয়া সেরে অটো ধরে পূর্বনিধারিত হোটেলে পৌঁছালাম।

পরের দিন সকাল সাতটা দশ-এর ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসে চেপে কালুপাড়াঘাট স্টেশনে নেমে বাইরে বেরিয়ে অটোতে টাঙ্গি হয়ে বামদিকের রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম মংলাজোড়ি। বোটের জন্য আগে থেকেই মধু বেহেরাকে ফোন করে রেখেছিলাম। অটো থেকে নেমে আমাদের জিনিসপত্র মধু বেহেরার গেস্টহাউসে রেখে ওনার ঠিক করা অটোতে চেপে বসলাম।

সরু মোরামের রাস্তা ধরে যখন অটো জলাভূমির দিকে এগোতে লাগল প্রথমেই চোখে পড়ল প্রচুর শামুকখোল। খাবার খুঁজতে খুঁজতে প্রায় রাস্তার একদম ধারে চলে এসেছে। গ্রে হেডেড সোয়াম্পহেন ও কমন মুরহেন-এর সংখ্যাও নজর কাড়ল। কিছুটা দূরে একটা ব্ল্যাক হেডেড আইবিস ও কিছু পিনটেল ভেসে রয়েছে। ঘাটে পৌঁছাতে খানিক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে অনেকেই নৌকা নিয়ে ভেসে পড়েছেন, আবার কোনও কোনও নৌকার ফেরার সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি নৌকাতে উঠে বসলাম, সঙ্গে আমাদের গাইড, বাইনোকুলার, ক্যামেরা ও সেলিম আলির একটা বই।

ঠিক করেছিলাম সারাদিনে দুবার বোটিং করব, সেইমত গাইড প্রথমে ডানদিকের বড় চ্যানেলটিকে বেছে নিয়ে চলা শুরু করল। প্রথমেই হাতের কাছে পেয়ে গেলাম ব্ল্যাক উইংগড স্টিল্ট ও ব্ল্যাক টেইল্ড গডউইট। এই ওয়েটল্যান্ডে সবথেকে বেশি সংখ্যায় পাওয়া যায় ব্ল্যাক টেল্ড গডউইট। স্টিল্ট ও ব্ল্যাক টেইল্ড গডউইট এমন ভাবে বসে রয়েছে যেন মনে হবে কেউ সাদা-কালো চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। এত কাছ থেকে এদের পেয়ে খুব সুন্দর কিছু ছবি পাওয়া গেল। ওদের যখন ছবি নিতে মগ্ন ছিলাম, সেই সময় আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে দুটো রাডিশেল ডাক কিছুটা দূরে এসে বসল। ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগোতে লাগলাম, কিন্তু কাছে যেতেই উড়ে গেল। কিছুটা এগোতে দেখতে পেলাম কয়েকটা নর্দার্ন পিনটেইল আপন মনে খাবার খুঁজছে। শীতের শুরুতে এরা যখন এখানে আসে, এত লম্বা উড়ানেরর পর তখন এদের শরীর একদম রুগ্ন থাকে, তারপর এখানের বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে অজস্র খাবার খেয়ে চেহারায় আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। আমরা যখন নর্দার্ন পিনটেইলের ছবি নেওয়ার মগ্ন তখন হঠাৎ গাইড ইশারা করে দেখাল, একটা নর্দার্ন শোভেলার সেই ঝাঁকের মধ্যে বসে রয়েছে। কিন্তু ভাল করে দেখার আগে ঝপাৎ করে উড়ে গেল, টেরই পেলাম না। গাইড আমাদের আশ্বস্ত করল পরে আরও কাছ থেকে ওদের দেখতে পাওয়া যাবে।

ওখান থেকে নৌকা ঘুরিয়ে ডানদিক বরাবর চলতে লাগলাম। একটু দূরেই দেখতে পেলাম একটি পার্পল হেরন একটা আস্ত মাগুর মাছকে ধরে খপাত করে মুখে পুরে নিল। এবার চলে এলাম নর্দার্ন শোভেলার-এর এলাকায়। ওখান থেকে ওদের কিছু ভালো ছবি পাওয়া গেলো সঙ্গে পিনটেইলেরও। এইভাবে যে কখন ঘড়িতে প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই টের পাইনি, খেয়াল হল পেটের টানে। তাড়াহুড়োর জন্য ভালো করে জলখাবার না করেই নৌকোতে উঠে পড়েছিলাম, খিদের জ্বালাটা ভালোই অনুভব করছি। মাথার ওপর রোদ্দুর আর পেটে খিদে, দেরি না করে মাঝিকে বললাম নৌকো ঘাটে নিয়ে যেতে। ঘাটে যাওয়ার রাস্তাতেই দেখতে পেলাম একটা ওয়ার্বলার হোগলা বনের মধ্যে ডেকেই চলেছে। ছবি পাওয়ার জন্য ওখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। মিনিট পাঁচেক পরে দেখলাম মহাশয় বের হলেন সঙ্গে একটি কমন স্নাইপও। আমরা ওদের কয়েকটা ছবি নিয়ে সোজা পাড়ে এসে উঠলাম।

পাড়ে ফিরে কিছুক্ষণ অটোর জন্য অপেক্ষা করতে হল। সেই সময় কানে এল, একটু দূরে একটি ছোট্ট পাখি শিস দিয়ে চলেছে, খানিক কাছে যেতে বুঝতে পারলাম ওটা একটি সাইবেরিয়ান ব্লুথ্রোট। আমাদের অটোচালক এসে ওড়িয়া ও হিন্দির সংমিশ্রণে কিছু বলতে লাগল, যার সারাংশ হল সামনের ঝোপে মধ্যে একটি সিনামন বিটার্ন বসে রয়েছে, তৎক্ষণাৎ অটোতে চেপে বসলাম। পৌঁছে দেখি ফুট দশেক দূরে একটি সিনামন বিটার্ন হোগলা ঝোপের মধ্যে শিকারের অপেক্ষায় বসে রয়েছে। জীবনে এই প্রথম সিনামন বিটার্ন দেখলাম। কয়েকটা ছবি তুলে আর দেরি না করে মধু বেহেরার গেস্টহাউসে এসে পৌঁছলাম।

দুপুরের খাবার রেডি ছিল, তাই সোজা টেবিলে গিয়ে বসে পড়লাম। খেতে খেতে দুজন প্রকৃতিপ্রেমীর সঙ্গে পরিচয় হল, পরিযায়ী পাখির টানে এখানে এসেছেন ওঁরা। আজ ও কাল এখানেই থাকবেন। লাঞ্চ শেষ করে দুটো চেয়ার নিয়ে গেস্টহাউসের পেছনে এসে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসলাম। গল্প করতে করতে হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখি তিনটে বাজতে আর বেশি দেরি নেই। সঙ্গে সঙ্গে অটো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আপাতত শেষবার মংলাজোড়ির বুকে ভেসে বেড়াতে। ঘাটে পৌঁছে গাইডকে বললাম হাতে সময় কম, তাই তাড়াতাড়ি বারহেডেড গুজ-এর কাছে নিয়ে যেতে।

মংলাজোড়িতে বারহেডেড গুজ-এর সংখ্যাটা খুবই কম। এখানকার তুলনায় আমাদের পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা বা বক্রেশ্বর ড্যামে এই বারহেডেড গুজ-এর আধিক্য চোখে পড়ার মতন। আমাদের কথা মতন মাঝিভাই বাঁদিকের বড় চ্যানেলটিতে নৌকা ভাসিয়ে দিল। পড়ন্ত দুপুরের মিঠে রোদ্দুরটা বেশ ভালই লাগল। প্রথমেই আমাদের চোখে পড়ল একটি স্মল প্রাটিনকোল। এদের গায়ের রং এমনই যে দূর থেকে দেখলে কিছুতেই বোঝা যাবে না, মনে হবে যেন মাটির সঙ্গে মিশে রয়েছে। যেই না আমাদের নৌকা কাছাকাছি গিয়েছে, এতক্ষণ মাটির সঙ্গে মিশে থাকা প্রায় কয়েকশ প্রাটিনকোলের ঝাঁক মাথার ওপরের আকাশটাকে ঢেকে ফেলল। এত কাছে থাকায় কিছু সুন্দর ছবি পাওয়া গেল। সকাল থেকেই কিছু হুইসকার্ড ট্রেনদের মাথার ওপর ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিলাম, এখন দেখি তারা ক্লান্ত হয়ে এক জায়গায় ঘাঁটি গেড়েছে। আমরা যখন তাদের ফটো তোলায় মগ্ন, গাইড আমাদের নজর ঘোরাল দুটো বারহেডেড গুজ দম্পতির দিকে। অনেক দূরে আপন মনে খাবার খুঁজে চলেছে। গাইডের কথা অনুযায়ী, এ বছর এরা খুব একটা কাছে আসছে না। আমরাও খানিক অপেক্ষা করে ওদের কাছাকাছি পেলাম না। যাইহোক ভালো ফটো নাই পেলাম, চোখে তো দেখতে পেলাম এই সান্ত্বনা। মার্শ হ্যারিয়র ও ব্রাহ্মণী চিলের দর্শন-এর জন্য কিছুটা এধার ওধার নৌকা নিয়ে ঘোরাঘুরি করলাম, ব্রাহ্মণী চিলের দেখা মিললেও এবারের মত মার্শ হ্যারিয়র-এর দেখা পেলাম না। মংলাজোড়িতে সবথেকে সুন্দর দৃশ্য হল মার্শ হ্যারিয়র-এর তাড়া খেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে গডউইটের নীল আকাশের বুকে উড়ে বেড়ানো। সেই দৃশ্য থেকে বঞ্চিত রয়ে গেলাম। নৌকা যখন হ্যারিয়র এর খোঁজে এপাশ ওপাশ ঘুরছে তখন একটু দূরে একটি পায়েড কিংফিশার মাছ ঠোঁটে নিয়ে অনবরত পাথরের ওপর আছাড় মারছে, সেই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করলাম। হাতে আর সময় নেই, সুতরাং মাঝি ভাইকে পাড়ের দিকে এগোতে বললাম। ফেরার পথে দেখতে পেলাম ইয়েলো বিটার্ন, বেইলনস ক্রেক, লিটল স্টিন্ট, প্লোভার, স্পট বিল ডাক, ওয়াটার কক, কমন মুরহেন আর গ্রে-হেডেড সোয়াম্প হেন।


নৌকা যখন ঘাটের কাছাকাছি তখন আমাদের গাইড পাশের নৌকাটির দিকে ইশারা করে এক ব্যক্তিকে দেখাল, যিনি হলেন এই মংলাজোড়ি ওয়েটল্যান্ডের রূপকার নন্দকিশোর ভুজবল। আজ এই ওয়েটল্যান্ড এর সংরক্ষণের পেছনে ওঁর অবদান বিরাট। বছর দশেক আগে পর্যন্ত এই জায়গায় অবাধ চোরাশিকার চলত। নন্দকিশোরজী তখন এখানকার মানুষজনকে বোঝাতে শুরু করলেন যে এই সব প্রাণীদের মেরে না ফেলে এদের সংরক্ষণের মাধ্যমেও ভালোভাবে জীবিকা অর্জন করা যায়। এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ওড়িশা সরকার তাঁকে 'বিজু পট্টনায়ক' পরিবেশ পুরস্কারে ভূষিত করেছে। মাঝিভাই বলল, এখনও নন্দকিশোরজী প্রায়ই নিয়ম করে এই ওয়েটল্যান্ড পর্যবেক্ষণে বের হন।

ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা বাজে, আমাদেরও পাখিদেখা এবারের মত শেষ। নৌকা থেকে নেমে মাঝি ও গাইডকে তাদের প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়ে অটোতে চেপে বসলাম ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে।


~ মংলাজোড়ির আরও ছবি ~

 

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটার পলাশ পান্ডা-র শখ ফোটোগ্রাফি ও বেড়ানো।

 


SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher