ভয়ঙ্কর সুন্দরের টানে
দেবাশিস বিশ্বাস
~ কাঞ্চনজঙঘা অভিযানের আরো ছবি ~
ওপরে ওঠাটা আসলে একটা নেশা। এভারেস্টের শিখর ছুঁয়ে ফেলার পরও সেই নেশাটাই আমাদের ফের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। আবার কোথায় যাওয়া যায় এটা নিয়ে বসন্তদার সঙ্গে ভাবতে বসে দু’জনের মাথাতেই প্রথমে এল একটাই নাম - কাঞ্চনজঙ্ঘা।
এভারেস্টের উচ্চতা নির্ভুলভাবে মাপার আগে পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘাকেই পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ বলে মনে করা হত। আদপে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম হয়েও কাঞ্চনজঙ্ঘা তার আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। কাঞ্চনজঙ্ঘার পাঁচটি শৃঙ্গ কাং বাচেন-৭,৯০৩ মিটার, ইয়ালুং কাং বা কাঞ্চনজঙ্ঘা ওয়েস্ট-৮,৫০৫ মিটার, কাঞ্চনজঙ্ঘা মেন-৮,৫৮৬ মিটার, কাঞ্চনজঙ্ঘা সেন্ট্রাল-৮,৪৮২ মিটার আর কাঞ্চনজঙ্ঘা সাউথ-৮,৪৯৪ মিটার। পাঁচ শৃঙ্গকে তুলনা করা হয় ঈশ্বরের পাঁচ সম্পদভান্ডারের সঙ্গে - সোনা, রুপো, মণি, খাদ্যশস্য ও পবিত্র গ্রন্থ। ১৯৫৫ সালের ২৫শে মে প্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘা জয় করেন জো ব্রাউন ও জর্জ ব্যান্ড। এরপরে এতবছরে আরও বেশ কিছু অভিযাত্রী।
হ্যাঁ, সেই কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানই টানছিল আমাদের - আমাকে আর বসন্তদাকে। এভারেস্টের পর এই অভিযানেও আমার পথের সাথী তথা নেতা বসন্তদা অর্থাৎ বসন্ত সিংহ রায়।
২৯ মার্চ, মঙ্গলবার, শিলিগুড়িতে ন্যাফের (হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন) সম্বর্ধনা, সাংবাদিক বৈঠক এসব সেরে আমরা রওনা দিলাম নেপাল সীমান্তের দিকে। কাকড়ভিটা থেকে ইলাম হয়ে ফিদিমে রাত্রিবাস। আমাদের অভিযানের সঙ্গী দুই শেরপা ভাই পাসাং আর পেম্বা।
৩০ মার্চ ভোর ভোর বেরিয়ে পড়লাম সদলবলে। সকাল সাড়ে ছটায় পৌঁছলাম মেডিবুং। এখান থেকে হাঁটতে হবে। আমাদের কুক ছটফটে যুবক লীলাবতী রাই , পাসাং-পেম্বার ভাই তাসি, নরবু, আসরম শেরপা আর পোর্টাররাও সবাই হাজির। অতএব, আমাদের যাত্রা হল শুরু...।
প্রথমেই পথ নেমে গেছে নীচের দিকে, ৪,৪০০ ফুট উচ্চতার মেডিবুং থেকে ২,২০০ ফুট উচ্চতায় নেমে আসা কাবেলি নদীর পাশে। পথ উত্তর দিক বরাবর। দড়ির ব্রিজের সাহায্যে নদী পেরোলাম। হালকা ঢাল বেয়ে এবার একটু-একটু করে উঠে যাওয়া। চোখে পড়েছে ধাপ চাষের ছবি। আলু, ভুট্টা, গম - প্রধানত এসবই চাষ হয় এই অঞ্চলে। এরই সঙ্গে প্রচুর ফুল ফুটে আছে চারিদিকে। আর রংবেরঙের প্রজাপতি। যাত্রার শুরুতেই তৈরি হয়ে গেছে এক অনন্য ভিজ্যুয়াল। যাকে অন্য মাত্রা দিচ্ছে নানান ধরণের পাখির ডাক।
মাঝে এক পশলা বৃষ্টি। হাঁটার ফাঁকেই একটুকরো বিশ্রাম - দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারা। আশপাশে ছোটখাট ঘরবাড়ি, দোকানপাট। আরও কিছুটা এগিয়ে আমেদিন গ্রাম। ছোট্ট, সুন্দর সাজানোগোছানো পাহাড়ি গাঁ। উচ্চতা ৩,৫৬০ ফুট। এখানেই বুংগা প্রাইমারি স্কুলে আমাদের রাত কাটানোর আয়োজন।
পরদিন সকাল সাতটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেড়িয়ে পড়ি। সঙ্গে প্যাকড লাঞ্চ। আশপাশে প্রচুর চাষের জমি। তার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলা। জিরিয়ে নেওয়ার জন্য পথের পাশে পাথরে বাঁধানো বসার জায়গা। ডানদিকে অনেক নীচে বয়ে চলেছে কাবেলি নদী। এবারে ওপরে ওঠার পালা। পৌঁছালাম দেওয়াং গ্রামে। কাবেলির বুকে এসে মিশেছে আরেকটি ছোট পাহাড়ি নদীর ধারা। দড়ির ব্রিজ পেরিয়ে ওপাড় থেকে উঠে গেছে খাড়া চড়াই। সেই চড়াই বেয়েই ওঠা। বেলা প্রায় সাড়ে বারোটায় পৌঁছলাম ধারাগাঁও। স্থানীয় একটা বাড়িতে খানিকটা জিরিয়ে নেওয়া গেল। মালকিনের কাছ থেকে কেনা সুস্বাদু দই খেয়ে ক্লান্তিও কাটলো।
তবে খুব বেশিক্ষণ বসার সময় নেই। যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। আবার নেমে পড়লাম পথে। আরও ঘন্টাখানেক পর পৌঁছলাম খেওয়াং। আজকের মতো এখানেই রাতের বিশ্রাম। আমাদের মালবাহকদের সর্দার কে বি লামার পরামর্শে প্রথম বাড়িটাতেই আশ্রয় নিলাম। পৌঁছে দেখি হাঁড়ির ওপর হাঁড়ি চড়িয়ে বুড়ি মালকিন তৈরি করছে ছাং - স্থানীয় মদ। পাহাড়ি মানুষজনের পছন্দের পানীয়।
পরদিন সকালে ফের বেড়িয়ে পড়া। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এগিয়ে চলা। বাড়ি, দোকানপাট, চাষের জমি নিয়ে জমজমাট গ্রাম। ইয়াম-ফু-দিন - আজকের গন্তব্য। এপথে এটাই শেষ বড় গ্রাম। পথে হঠাৎই চোখে পড়ল, মাচা বানিয়ে চারজনের কাঁধে ভর করে নামিয়ে আনা হচ্ছে এক ব্যক্তিকে। জানা গেল, অসুস্থ এক মানুষকে চিকিৎসার জন্য নীচে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এছাড়া আর কোনও উপায় নেই এইসব পাহাড়ি গ্রামে। অপরিসীম কষ্টকর এই পার্বত্য জীবনের কথা ভাবলে সত্যি শিউরে উঠতে হয়। ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠতে থাকি। এসব অঞ্চলে ছেত্রী, রাই প্রভৃতি উপজাতির মানুষজন বাস করেন। এঁরা অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সামান্য কিছু খ্রিস্টানও আছেন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শেরপারা থাকেন আরও ওপরে। প্রায় ৬,৬৬০ ফুট উচ্চতায়। উঠে আবার নামার পালা -প্রায় হাজার ফুট নীচে। পাহাড়ি পথে এভাবেই চড়াই-উতরাই ভেঙে এগিয়ে চলা। মাঝে দু-এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গিয়েছে। সেই পিছল পথে এগিয়ে চলা অতি সন্তর্পণে। যেদিকেই চোখ যায় বিচিত্র পাহাড়ি দৃশ্য। কোথাও তামাক চাষের জমি, কোথাও পাহাড়পথে নেমে এসেছে ঝরনা, কোথাও ফুটে রয়েছে আশ্চর্য সব ফুল, কখনও উড়ে যাচ্ছে রঙিন প্রজাপতি। মাঝে দু-একটা বাড়ি পড়েছে বটে, তবে এ পথের বেশিরভাগই জঙ্গল। সঙ্গে চড়াই-উতরাই তো আছেই। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর উঠে এলাম একটা গিরিশিরার মাথায়। উচ্চতা ৬,৩৮০ ফুট। আশপাশে দু-একটা বাড়ি, কিছু চাষের জমি। আবার নেমে আসা। খানিকক্ষণ নদীর পাশে পাশে চলার পর ব্রিজ পেরিয়ে পৌঁছালাম ইয়াম-ফু-দিন। ইয়াম-ফু-দিনের দুটি গ্রাম। ওপরের বৌদ্ধ গ্রামে শেরপাদের বাস। এটি নীচের গ্রাম। এর উচ্চতা প্রায় ৫,২০০ ফুট। রয়েছে বেশ কিছু ঘরবাড়ি। যথেষ্ট উন্নত এই গ্রামটি। এই গ্রামেই রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা কানজারভেটিভ এরিয়া অফিস। নাম নথিভুক্ত করিয়ে নিলাম দুজনেই।
আবার এগিয়ে চলা উপরের দিকে। লক্ষ্য আপার ইয়াম-ফু-দিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি। টাঙানো রয়েছে বর্ণময় প্রেয়ার ফ্ল্যাগ। আশপাশের ছবিই বলে দিচ্ছিল ইয়াম-ফু-দিনের ওপরের এই গ্রামটি বেশ বর্ধিষ্ণু। সোলার প্যানেল থেকে টেলিফোন - বিবিধ সুযোগ সুবিধে এখানে রয়েছে। উচ্চতা ৬,৫০০ ফুট। এখানেই ইয়াম-ফু-দিন গেস্ট হাউসে রাত্রিবাস।
পরদিন, ২ এপ্রিল, শনিবার। ফের হাঁটা শুরু জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। উত্তর-পূর্ব অভিমুখে ঢাল বরাবর এগিয়ে চলা। চোখে পড়ছে অজস্র ফুল, প্রজাপতি আর পাখি। ঢাল ছেড়ে এবার একেবারে মারাত্মক চড়াই। অল্প বিশ্রাম করে নিয়ে আবার ধীরে ধীরে খাড়াই বেয়ে উঠতে লাগলাম। প্রায় দেড় ঘন্টায় খাড়া চড়াই পেরিয়ে কিছুটা সমতল অংশে পৌঁছালাম। চারপাশে যেন ফুলের আগুন লেগেছে – উদ্ধত যত শাখার শিখরে নানান রঙের রডোডেনড্রনগুচ্ছ। থোকা থোকা গাঢ় বেগুনি রঙের ফুলে ছেয়ে রয়েছে পুরো ঢালটা। যেন অনেকটা বেগুনি রঙ কেউ ঢেলে দিয়েছে মাটিতে। ফুলগুলোর মিষ্টি গন্ধ ছেয়ে রয়েছে পাহাড়জুড়ে। আরও কত ফুল – কত রঙবেরঙঙের পাখি – হায়, প্রায় কাউকেই চিনিনা। উঠে এলাম প্রায় ১১,০০০ ফুট উচ্চতার লাসেথাং-এ। পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট জায়গা। গ্রামের চালাঘরে কাঠের উনুনের আগুনের ভাপে নিজেকে তাতিয়ে নিতে নিতে লীলার তৈরি পুরি, সবজি আর ডিমসেদ্ধ দিয়ে চমৎকার প্যাক লাঞ্চ সেরে আবার বেরিয়ে পড়া, আবার চড়াই। দুপাশে রডোডেনড্রনের জঙ্গল। পাহাড়ের মাথা থেকে আবার নামা নীচের দিকে। ৯,৪০০ ফুটে নেমে সঙ্গী হল সিম্বুয়াখোলা নদী। ওপাড়ে তোরনদিন। রাতটা আজ এখানেই কাটবে। শরীরটা ধাতস্থ করতে আরও একদিন কাটিয়ে দিলাম এখানে।
৪ এপ্রিল, সোমবার। আজ গন্তব্য, সেরাম। শুরুতেই হালকা ঢাল বেয়ে উঠে যাওয়া। মেঘলা আকাশ, মাঝেমাঝে বরফ পড়ছে। যেন শিল্পীর আঁকা ছবি, তার মধ্য দিয়েই ছবির একটা চরিত্র হয়ে এগিয়ে চলা। নীচে বয়ে চলেছে সিম্বুয়াখোলা। আস্তে আস্তে কমে আসছে গাছের সারি। পথ আরও ওপরের দিকে। সামনে শৃঙ্গের শ্রেণি - কোকথাং - তার বাঁ পাশে কাবরু। ঘন্টা চারেকে পৌঁছালাম সেরাম। উচ্চতা প্রায় ১২,০০০ ফুট। আগামী দু-দিন এখানেই থাকব।
৬ এপ্রিল, বুধবার। সকালে ব্রেকফাস্ট সারছি এমন সময় খবরটা প্রায় ব্জ্রপাতের মতই এল। শেরিং এসে জানাল আমাদের মেট কে বি লামা মারা গেছেন। আমাদের আগে গতকালই উনি সেরাম থেকে রামচের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁবুতেই মৃত্যু হয়। খাওয়া ফেলে উঠে পড়লাম। টেলিফোনে খবর দিলাম আমাদের এজেন্সি লোবেনকে। ওরা জানাল একটা হেলিকপ্টার আসছে, ওতেই মৃতদেহটা পাঠিয়ে দিতে। সত্যি বিশ্বাস হচ্ছিলনা কথাটা - যার সঙ্গে দু’দিন আগেই কথা বলেছি, সেই মানুষটা নেই...। ওর ভাই শেরিং আর পাসাং আগেই বেরিয়ে গেল রামচের দিকে। দুপুরে পেম্বা ফিরলে জানতে পারলাম শেরিং ওর দাদার মৃতদেহ নিয়ে হেলিকপ্টারে নীচে নেমে গেছে।
৭ তারিখ সকালে আবার বেড়িয়ে পড়লাম। গন্তব্য সেই রামচে। গতকাল প্রচুর বরফ পড়েছে। বরফে ঢাকা পথে চলতে বেশ অসুবিধাই হচ্ছে, জুতো-মোজা ভিজে পা একেবারে ঠান্ডা আর অসাড় হয়ে যাচ্ছে। বরফে পা পিছলেও যাচ্ছে মাঝে মাঝে। লাঠিতে ভর দিয়ে সাবধানে এগোচ্ছি। আশপাশে গাছ ক্রমশ আকারে ছোট আর সংখ্যায় কমে আসছে। যেন বড় বড় গাছগুলো হিমালয়ের কাছে মাথা নত করতে করতে ঝোপঝাড়ে মিশে যাচ্ছে। সাড়ে এগারোটা নাগাদ ১৪,৩০০ ফুট উঁচু রামচেতে পৌঁছালাম। এখানে রয়েছে পাথরের তৈরি একটি ঘর। আর সামনের ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে প্রচুর তাঁবু। রয়েছেন দেশ-বিদেশের আরও অনেক অভিযাত্রী। সুদূর বিস্তৃত পথের উপরে দেখা যাচ্ছে একাধিক শৃঙ্গ। রাথোং (৬,৬৮২ মি), কোকথাং (৬,১৪৮ মি), কাবরুর পিকগুলো (৭৪১২, ৭৩৩৯, ৭৩৩৮ আর ৭৩১৮ মি)। চোখে পড়ছে ইয়ালুং গ্লেসিয়ারের রাইট ল্যাটারাল মোরেন। হিমবাহের এগিয়ে চলার পথে ফেলে রাখা পাথর-বালি-মাটির গ্রাবরেখা। আগামী দিন তিনেক থাকতে হবে এখানেই। তাই সাজিয়ে নেওয়া হল তাঁবু।
পরের তিন দিন ধরেই চলল টানা তুষারপাত। শুধুই তুষার ঝরছে। মাঝে মাঝে রোদ উঠে সেই তুষার গলিয়ে দিচ্ছে। একটুক্ষণ পরেই ফের শুরু হচ্ছে। চারপাশে জমে যাচ্ছে তুষার। আর জমে উঠছে তুষারমানব বানানোর খেলা। ১১ এপ্রিল আবার বেরিয়ে পড়া। এবার ডিপোজিট ক্যাম্পের দিকে পা বাড়ালাম। পথ প্রথমে পূর্ব দিকে গিয়েছে। তারপর ঘুরেছে উত্তর-পূর্ব দিকে। বাঁ-দিকে ঘুরেই চোখে পড়ল কাঞ্চনজঙ্ঘার বিভিন্ন শৃঙ্গ। যার টানে চলে আসা সমতল ছেড়ে, এই উঁচুনিচু পাহাড়ি জীবনে। বাঁদিকে ইয়ালুং কাং বা কাঞ্চনজঙ্ঘা ওয়েস্ট, তারপর কাঞ্চনজঙ্ঘা মেন, তার ডানদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সেন্ট্রাল, আর তারপর কাঞ্চনজঙ্ঘা সাউথ। এরপর গিরিশিরা নীচে নেমে ফের উঠে গেছে তালুং শৃঙ্গে। তার দক্ষিণে কাবরু, তারও দক্ষিণে রাথোং, এরপর কোকথাং হয়ে নেমে গিয়েছে নীচে। এই গিরিশিরাই সিকিম আর নেপালের সীমানা নির্ধারণ করেছে। সকাল পৌনে দশটা নাগাদ পৌঁছলাম ওকথাং। ১৪,৯০০ ফুট। এখানেই পাথরের পর পাথর সাজিয়ে গড়ে উঠেছে শিবের উপাসনাস্থল। পুজো শেষে ফের হাঁটা। মনে একটাই কামনা, যাত্রায় যেন কোনও বিঘ্নও না ঘটে। এবার নেমে আসা নীচে, ইয়ালুং গ্লেসিয়ারের বুকে। বাঁদিকের ঢাল থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ার ভয়। এগিয়ে চলা হিমবাহের ওপর দিয়েই। চোখে পড়ছে কোথাও গ্লেসিয়াল পুল, কোথাও গ্লেসিয়াল টেবল। আরও খানিক এগিয়ে পড়ল বেশ কিছুটা ফাঁকা জমি। এখানে অন্য দলের তাঁবু পড়েছে। আমরা পেরিয়ে চলি। দুপুর দুটো নাগাদ পৌঁছালাম ডিপোজিট ক্যাম্প। ১৫,১০০ ফুট। এখানেই তাঁবু লাগানো হল।
১৩ এপ্রিল রওনা বেসক্যাম্পের দিকে। উত্তর-পূর্বে। গ্লেসিয়ারের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। বড়ো কষ্টকর এই পথ। বড়বড় পাথর ঢেকে রয়েছে বরফে। প্রতি পদক্ষেপেই পিছলে পড়ার ভয়। তবু এগিয়ে চলা। উঠে-নেমে, কখনও ডানদিক, কখনও বাঁদিক -এভাবেই ভারী সন্তর্পণে এগোনো। ইয়ালুং গ্লেসিয়ার বরাবর। বাঁদিকে জানু থেকে একটি গ্লেসিয়ার এসে মিশেছে ইয়ালুং-এ। আরও কিছুটা এগিয়েই উঠে গিয়েছে খাড়া রাস্তা। খাড়াই পথ ধরে উঠে অবশেষে পৌঁছনো গেল বেসক্যাম্পে। শেরপারা শুরু করে দিল তাঁবু লাগানোর কাজ। বেশ কদিনের আশ্রয় এখানেই, তাই মেম্বারদের তাঁবুর পাশাপাশি তৈরি করা হল কিচেন টেন্ট, ডায়নিং টেন্ট, টয়লেট টেন্ট। আর এসবের সঙ্গে তৈরি হল মন্দির।
বেশ ছড়ানো-ছেটানো জায়গায় এই বেসক্যাম্প। উচ্চতা প্রায় ১৭,৫০০ ফুট। এখানে দেখা মিলল প্রচুর পাখির। বেসক্যাম্পের পর, পরপর দুটো বরফের ঢাল, তারপরেই পাথরের দেওয়াল। এর উপরে রয়েছে বরফের খাড়া প্রাচীর। আর তার পিছনেই অপরূপ সেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। তার চারটি শৃঙ্গ এখান থেকে দৃশ্যমান, শুধু আড়ালে পড়ে গিয়েছে পঞ্চম শৃঙ্গ কাংবাচেন। বেসক্যাম্পের পশ্চিম দিকে দেখা যাচ্ছে জানু বা কুম্ভকর্ণ শৃঙ্গ।
আমাদের দুজনের জন্য আলাদা আলাদা দুটি তাঁবু লাগানো হয়েছে। এখন থেকে আমাদের সঙ্গী পেম্বা, পাসাং ও তাসি। আর কুক লীলাবতী ও তাঁর সহকারী দাওয়া। বাকি শেরপাদের কাজ শেষ, তাঁরা ফিরে গেলেন দার্জিলিং।
বেসক্যাম্পে দেখি আরও চারটি দল রয়েছে। রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ, প্রেস্টিজ গ্রুপ আর সেভেন সামিট ট্রেক। এই সেভেন সামিট ট্রেক দলের কর্ণধার বিখ্যাত মিংমা শেরপা, যিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের ১৪টি আট হাজারি শৃঙ্গের ১৩টিই আরোহণ করে ফেলেছেন। বাকি আছে শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘা। এখানে সফল হলে, তিনিই হবেন এই অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী প্রথম সাউথ এশিয়ান।
১৭ এপ্রিল। রওনা দিলাম ক্যাম্প ওয়ানের পথে। সঙ্গে পেম্বা। আজকে অবশ্য ট্রায়াল রান - আবহাওয়া আর প্রকৃতির সঙ্গে শরীরকে খাপ খাওয়ানোর - উচ্চতা আর তাপমাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। রওনা দিলাম সকাল পৌনে নটায়। পাথর-বোল্ডারের জমি পেরিয়ে খাড়া দুটি বরফের ঢাল ভেঙ্গে ওপরে ওঠা। ১৮,৪৬০ ফুট উচ্চতায় পৌঁছালাম সাড়ে এগারোটায়। আজ এই পর্যন্তই। মিনিট পনেরো ক্যাম্প ওয়ানের আগে এই বরফের ঢাকা পাথুরে দেওয়ালের গোড়ায় কাটিয়ে আবার নেমে এলাম বেসক্যাম্পে।
১৮ এপ্রিল। দিনটা শুরু হল পুজো-অর্চনার মধ্য দিয়ে। যাত্রার সাফল্য কামনা করে পুজো দিলাম আমরা। লামার ভূমিকায় অন্য দলের দুই শেরপা। অন্যান্যরাও মেতে উঠলেন এই পুজোয়। টাঙানো হল প্রেয়ার ফ্ল্যাগ। বাকি দিনটা কাটল বিশ্রামেই। ল্যাপটপে ছবি দেখে, গান শুনে। আগেই লাগানো হয়েছে সোলার প্যানেল। তা থেকেই মোবাইল বা ল্যাপটপের চার্জ দেওয়া যাচ্ছে। কিচেন আর ডাইনিং-এ আলোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে এই বিদ্যুৎ।
২০ এপ্রিল। সকাল সাতটা চল্লিশ। বেসক্যাম্প ছেড়ে রওনা দিলাম। আকাশে তখন মেঘ-রোদের লুকোচুরি। আগের দিন প্রচুর তুষারপাত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পথ চলায় বেশ সমস্যা হচ্ছে। কখনও গোড়ালি পর্যন্ত ডুবছে বরফে, কখনও হাঁটু। কষ্ট কিছুটা লাঘব করতে আগের যাত্রীর পায়ের ছাপে ছাপে পা মিলিয়ে হাঁটা। ধীরে ধীরে সেই পাথুরে দেওয়ালের গোড়ায় উঠে এলাম। এরপর প্রাণান্তকর চড়াই। দমবন্ধ করা আরোহণ। ফিক্সড রোপে জুমার লাগিয়ে খাড়া দেওয়ালে শরীরটাকে টেনে তোলা। এ পথেই বেলা দেড়টা নাগাদ উঠে এলাম ক্যাম্প ওয়ানে। উচ্চতা প্রায় ২০,৩০০ ফুট। এখান থেকে আশপাশটা স্পষ্ট দেখা যায়। ওই যে ইয়ালুং গ্লেসিয়ার। ইয়ালুং কাং-এর পায়ের কাছ দিয়ে বের হয়ে দুভাগ হয়েছে। তারপর ক্যাম্প ওয়ানের ডানদিক আর বাঁদিক দিয়ে নেমে গিয়েছে। ফের মিশেছে বেসক্যাম্পেরও নীচে গিয়ে। সেদিন ক্যাম্প ওয়ানেই থেকে পরদিন আবার নেমে এলাম বেসক্যাম্পে। এরপর ক-দিন বেসক্যাম্পে বিশ্রাম।
ফের বেরিয়ে পড়া ২৮ এপ্রিল। ইতিমধ্যে শেরপারা ক্যাম্প থ্রি পর্যন্ত রুট ওপেন করে ফেলেছেন। পথ চেনা হলেও গত কয়েকদিন প্রচুর তুষারপাতের জন্য পুরো পথের চেহারাটাই পাল্টে গিয়েছে। তাই পথ চলার কষ্টও বেড়ে গেল অনেক। একই দড়িতে পরপর আটকে আমরা চলেছি। সঙ্গে অন্যদলের লোকজনও রয়েছে। একেক সময় ঢাল এতটাই খাড়াই যে ওপরের লোকের পায়ের চাপে বরফ ভেঙে নীচের লোকজনের মাথায় এসে পড়ছে। পেম্বা আগেই সতর্ক করেছিল। আমরাও চেষ্টা করছিলাম তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যেতে। কিন্তু পুরো বিপদ কাটানো গেলনা। বারতিনেক তুষার ধস ভেঙ্গে পড়েছিল আমাদের ওপর। তবে বরফ নরম থাকায় তেমন কিছু হয়নি। সাতটা নাগাদ বেসক্যাম্প থেকে রওনা দিয়ে ক্যাম্প ওয়ান পৌঁছালাম সাড়ে বারোটায়। আবহাওয়া বেশ খারাপ। আজকের মত আর এগোনো নয়, ঘোষণা করল বসন্তদা।
পরদিন গন্তব্য ক্যাম্প টু। সামনেই খাড়া বরফের ঢাল। ঢাল বেয়ে উঠে এলাম একটা বরফের রিজের মাথায়। এরপর বাঁদিকে পাথরের দেওয়াল বরাবর ট্র্যাভার্স করে নীচের দিকে নামা। এই জায়গাটুকু রক-ফল-জোন। বাঁদিকের দেওয়ালের ওপর থেকে যেকোনও সময় পাথর পড়ার ভয়। এরপর বরফের লম্বা ময়দান। আরও এগিয়ে সামনে পড়ল বরফের ঢাল। এতসব পেরিয়ে পৌঁছালাম ক্যাম্প টু। এখানে তাঁবু লাগানোর কাজ মোটেও সহজ নয়। প্রথমে কাটতে হল বরফের ঢাল। তারপর আলগা বরফ পা দিয়ে বিটিং করে লাগানো হল তাঁবু। দুটো তাঁবু লাগানো হল। একটা আমাদের আর অন্যটা শেরপাদের জন্য। শেরপাদের তাঁবুতেই রান্নার ব্যবস্থা। পাশের আইস ওয়াল থেকে বরফ কেটে, তা গ্যাস বার্নারে গলিয়ে তৈরি হল জীবনদায়ী জল।
ক্যাম্প টু-র উচ্চতা প্রায় ২১,০০০ ফুট। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার চারটি শৃঙ্গ। চোখে পড়ে তালুং, কাবরু। হ্যাংগিং গ্লেসিয়ার ও আইস ফল জোন হওয়ার কারণে আশেপাশে অজস্র বরফের ভাস্কর্য। আর তার সঙ্গে রয়েছে প্রচুর বরফের ফাটল বা ক্রিভাস। যার গভীরে চোখ রাখলে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যায়না। যে অন্ধকারের প্রতিশব্দ, মৃত্যু। অতএব, চলাফেরা খুউব সাবধানে।
ঠিক ছিল ক্যাম্প টু থেকে উঠে যাওয়া হবে ক্যাম্প থ্রি-র দিকে। কিন্তু বাধ সাধল আবহাওয়া। আবার নীচে নেমে এলাম। গন্তব্য সেই বেসক্যাম্প। পর্বতারোহণে এই ওঠা-নামা লেগেই থাকে। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া অ্যাক্লেমাটাইজড হওয়া। বেসক্যাম্পে এসে আপাতত অনুকূল আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা চলল।
অবশেষে খবর মিলল, ১০ মে-র পর কাঞ্চনজঙ্ঘার উপরের দিকের আবহাওয়া কিছুটা সুবিধেজনক থাকবে। হাওয়া থাকবে কম। সেই মত ১৩ মে বেরিয়ে পড়লাম বেসক্যাম্প থেকে। সকাল সোয়া আটটা। এগিয়ে চললাম সেই একই পথে। চেনা পথ কিন্তু অচেনা বিপদ যেকোনও সময় এসে দাঁড়াতে পারে পথ রোধ করে। তাই সন্তর্পণে এগিয়ে চলা। একটানা। সোজা উঠে গেলাম ক্যাম্প ওয়ান ছাড়িয়ে ক্যাম্প টু-র দিকে। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর, খিদে-তেষ্টায় অসহনীয় অবস্থা। তবু, কোন কিছুর কাছেই না হেরে পৌঁছালাম ক্যাম্প টু। তখন বিকেল চারটে।
পরদিন আবার বেরিয়ে পড়লাম। এবার লক্ষ্য ক্যাম্প থ্রি। খাড়া চড়াই বেয়ে একটু একটু করে এগোনো। বহু দিনের প্রাচীনত্ব এখানে বরফের রং করে দিয়েছে সবুজ। সেই নিরেট বরফ বেয়ে ওঠা, দড়িতে জুমার লাগিয়ে টেনে-টেনে চলা। হঠাৎই থামতে হল। পথ নেই, সামনেই এক অতলান্ত ক্রিভাস। প্রকৃতির আশ্চর্য ম্যাজিকেই এখানে আগে গড়ে উঠেছিল বরফের একটি স্বাভাবিক সেতু, যাকে বলে আইস ব্রিজ। সেই সেতু বেয়েই চলাচল হত। মুশকিল হল, প্রকৃতির খামখেয়ালীতে তা ভেঙে গেছে। এ খবর অবশ্য আগেই জানতাম। কিন্তু এখন উপায়? সহায় হল শেরপারা। পেম্বা আর তাসি-র আজই বেসক্যাম্প থেকে উপরে উঠে আসার কথা। সেসময়ই তাঁরা নিয়ে এলেন পরিত্যক্ত একটি অ্যালুমিনিয়াম ল্যাডার। আগের কোনও আরোহী দল ক্যাম্প ওয়ানের কাছে লাগিয়ে ছিল। সেই মই-কে কাজে লাগিয়েই পেরোনো হল ক্রিভাস। ধীরে ধীরে, ভারী সন্তর্পণে। ফের বরফের খাড়া দেওয়াল। ফের ক্রিভাস। একের পর এক খাড়া দেওয়াল আর ক্রিভাস পেরিয়ে বিকেল চারটে নাগাদ পৌঁছালাম ক্যাম্প থ্রি। উচ্চতা ২৩,০০০ ফুট। পরের দিনটা কাটল ক্যাম্প থ্রি-তেই। বিশ্রামে।
১৬ মে, সোমবার, রওনা দিলাম ক্যাম্প ফোরের দিকে। লাগিয়ে নিলাম অক্সিজেন মাস্ক। এরপরতো প্রয়োজন পড়বেই। প্রথমেই খাড়া বরফের ঢাল। বড়ো কষ্টকর এই যাত্রা। কোনও মতে, অতি সাবধানে, ঢালের ওপরে উঠলাম। আবার একটি ঢাল, তবে তুলনামূলক কম গ্র্যাডিয়েন্টের। সেই ঢাল পেরিয়ে পড়ল বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা। এবার সোজা ইয়ালুং কাং-এর দিকে চলা। আশপাশে বরফের বিচিত্র সব ভাস্কর্য। যেন কোন অজানা শিল্পীর অপূর্ব নির্মাণ। এ পথে সুন্দর যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ভয়ঙ্করও। চতুর্দিকে ভয়াবহ সব ফাটল। ডানদিক-বাঁদিক ঘুরে ঘুরে এগোনো। পথ যেন ক্রমশই আরও লম্বা হচ্ছে। পা হচ্ছে ভারী। তবু এগিয়ে চলা ছাড়া এখানে আর কোনও উপায় নেই। আরও অনেকটা এগিয়ে অবশেষে ক্যাম্প ফোর। সামিট ক্যাম্প। উচ্চতা ২৫,০০০ ফুট। এখানেও বরফের ঢাল কেটে তাঁবু খাটানো হল।
আপাতভাবে মনে হতেই পারে এত উচ্চতায় বরফের রাজ্যে ঠান্ডায় তীব্রতা মারাত্মক। রাতের বেলা কথাটা সত্যিও বটে। কিন্তু দিনের বেলা, সূর্যের আলো বরফে প্রতিফলিত হয়ে তাপমাত্রা অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। কখনও তা চল্লিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেরও বেশি। এসময় তাঁবুর ভেতরে বসে থাকাও কষ্টকর। সঙ্গে বাতাসে অক্সিজেনের হার কমে যাওয়ার কষ্ট তো আছেই। অগত্যা ভরসা, বয়ে আনা অক্সিজেন সিলিন্ডার।
এখান থেকে আরও স্পষ্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা মেন। বাঁ পাশে ইয়ালুং কাং আর ডান পাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা সেন্ট্রাল। তারও ডানপাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা সাউথ। এই কাঞ্চনজঙ্ঘা মেন ও ইয়ালুং কাং-এর মাঝের ঢাল বরাবরই উঠে গিয়েছে পথ। পৌঁছেছে মূল অভীষ্টে। কাঞ্চনজঙ্ঘায়। বলা বাহুল্য, সে পথ একেবারেই মসৃন নয়। সঙ্গে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনাও বড় অন্তরায়। প্রতীক্ষা তাই প্রহরবিহীন। অনুকূল আবহাওয়ার আর দেখা মেলে না। সকালে একরকম ওয়েদার রিপোর্ট আসে, বিকেলে দেখা যায় তার উল্টো। ইতিমধ্যেই যোগ দিয়েছেন রুশ, ফরাসী ও সেভেন সামিট ট্রেক দলের সদস্যরা।
১৮ মে। ইতিমধ্যেই ওপরের রাস্তা দেখে, রুট ওপেন করে এসেছেন শেরপারা। অবশেষে রওনা। বিকেল তখন পাঁচটা বেজে গেছে। কিছু দূর এগোতেই হঠাৎই মেঘলা হয়ে এল আকাশ। শুরু হল হাওয়া। সঙ্গে তুষারপাত। এর মধ্যেই কেটে গিয়েছে মিনিট চল্লিশেক। বিপদ বুঝে আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি। নীচ থেকে শেরপারাও ডাকাডাকি শুরু করেছেন। অগত্যা ফিরে আসা ছাড়া উপায় নেই। সেই রাতটা ক্যাম্প ফোরেই কাটল।
১৯ মে, বৃহস্পতিবার। আরেকবার পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া হল অক্সিজেন সিলিন্ডার, মাস্ক। কেননা, এবারই চূড়ান্ত যাত্রা। একটু এদিক ওদিক হলেই নিশ্চিত মৃত্যু। বিকেল পাঁচটায় ফের বেরিয়ে পড়লাম। এবার সঙ্গী অন্য অভিযাত্রী দলের সদস্যরাও। বিকেলের রোদ তৈরি করেছে এক অভূতপূর্ব আবহ। পাহাড়ের মাথায় যেন রঙের খেলা। বাঁদিকে জানু আর ইয়ালুং কাং-এর ফাঁক দিয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর পঞ্চম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাকালু। তার ডানদিকে পৃথিবীর চতুর্থ উচ্চতম শৃঙ্গ লোৎসে। তারই পাশ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সেই মাউন্ট এভারেস্ট। এ যেন উচ্চতার প্রতিযোগিতা। ক্রমশ এক অনবদ্য ছবি তৈরি করল সন্ধ্যার আলো। এ পথেই এগিয়ে যাওয়া। একবারের জন্য থামা মানেই বিরাট অপচয়। একবার দলছুট হওয়া মানেই মৃত্যুর কাছে পৌঁছে যাওয়া। দমবন্ধ করে তাই শুধুই হেঁটে চলা। নেমে এল সন্ধের অন্ধকার। হেড-টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে চললাম। দুর্গম পথ। কিন্তু চমৎকার নিসর্গ। বুদ্ধ পূর্ণিমার পরদিন - চাঁদের আলোয় সে এক মায়াবী পরিবেশ।যেন পৃথিবীর এক অনাবিষ্কৃত রূপ। রাতভর চলল আরোহণ। ভোর চারটে নাগাদ ক্রমশ পরিষ্কার হতে লাগল আকাশ। পশ্চিম আকাশে তখন কাবরুর ছায়া। সামনে বরফ আর পাথরের ঢাল। সে পথেই এগিয়ে চলা। এরপর সূর্য উঠল। জানুর ওপর তখন কাঞ্চনজঙ্ঘার ছায়া। আর হয়তো কিছুক্ষণ। তারপরই সেই চূড়ান্ত মুহূর্ত। বহু কষ্ট করে উঠতে হল শেষ পর্যায়ে। কোনও মতে, ঘষটে ঘষটে। অবশেষে চূড়ার বর্গাকার সমতলে উঠে এলাম। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে সাতটা। ২০ মে। শুক্রবার।
হ্যাঁ, আরেকটা ইতিহাস রচনা হল। প্রায় বিশ্বাস হচ্ছিল না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারপাশ দেখতে লাগলাম। ওই তো, দূরে দেখা যাচ্ছে মাকালু, লোৎসে আর এভারেস্ট। গত বছরই এভারেস্টের শীর্ষ থেকে এমন করেই দেখেছিলাম কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। আজ কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া থেকে এভারেস্ট দর্শন - মনের মধ্যে অপূর্ব এক অনুভূতি। পশ্চিমে একটু নীচে যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে এমন দূরত্বে ইয়ালুং কাং। পূর্ব দিকে যেন ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে কাঞ্চনজঙ্ঘা সেন্ট্রাল। আরও পিছনে কিছুটা অস্পষ্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা সাউথ। দক্ষিণে দূরে রয়েছে কাবরু। সব মিলিয়ে, সে এক অনির্বচনীয় মুহূর্ত। শুরু হল পুজো দেওয়া আর ছবি তোলার পালা। কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষে তখন আমরা দু’জনে ছাড়াও শেরপাদের তিন ভাই - পাসাং, পেম্বা ও তাসি। এ-ও এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। একই সঙ্গে একই দিনে কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষে তিন ভাই! অতঃপর ওয়াকিটকির মাধ্যমে নীচে লীলাবতীকে জানিয়ে দেওয়া হল সাফল্যের খবর। এবার ঘরে ফেরার পালা...।
~ কাঞ্চনজঙঘা অভিযানের আরো ছবি ~
ইনকাম ট্যাক্স অফিসার দেবাশিসের ভালোলাগা-ভালোবাসার সবটুকুই পাহাড়কে ঘিরে। ১৯৯৭ থেকে তাঁর পাহাড়চূড়ার অভিযান শুরু হয়েছিল। মাউন্ট কামেট, শিব, শিবলিঙ্গ, পানওয়ালিদর, রুবাল কাং – এই পাঁচ শিখর ছোঁয়ার পর বসন্ত সিংহ রায়ের সঙ্গে যৌথভাবে প্রথম অসামরিক বাঙালি পর্বতারোহী হিসেবে ২০১০ সালে এভারেস্ট আরোহণ। এরপর ২০১১-য় প্রথম অসামরিক ভারতীয় পর্বতারোহী হিসেবে বসন্ত সিংহ রায়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখর ছোঁয়ার ২০১২-র ২০ এপ্রিল অন্নপূর্ণা-১ শিখরজয়ী প্রথম অসামরিক বাঙালি।
![]() |
||