মায়াভরা পথে মদমহেশ্বর

পল্লব চক্রবর্তী


~ মদমহেশ্বরের তথ্য ~ মদমহেশ্বরের ট্রেকরুট ম্যাপ ~ মদমহেশ্বরের আরও ছবি ~


আমি কিন্তু কোনও ভক্তিরসের সন্ধানে এই পথ হাঁটিনি। সোনার কেল্লার মন্দার বোস রাজস্থানের রাজপুতদের সম্পর্কে বলেছিলেন, "এরা তো যেখানে পেরেছে সেখানে একটা করে কেল্লা গুঁজে রেখেছে"। একই ভাবে দেবভূমি গাড়োয়ালে পাহাড়ের আনাচে কানাচে একটা করে মন্দির গোঁজা থাকবে আর পুরান-ইতিহাস-লোকগাথা মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে – সে আর আশ্চর্য কী! মদমহেশ্বর ট্রেক মানেই ধারণা ছিল – বহু নিচে বয়ে যাওয়া মধুগঙ্গার গুঞ্জন, ছোট-বড় ঝরনা, জঙ্গলপথ আর সবার ওপরে বুড়ো মদমহেশ্বরে চৌখাম্বার স্বর্গীয় প্রতিবিম্ব। কিন্তু মদমহেশ্বর পৌঁছে বদলে গিয়েছিল সে ধারণা, বুঝেছিলাম হিমালয়ের একচ্ছত্রাধিপতি মহাদেবের অধিষ্ঠানের উপযুক্ত এই স্থান। সবুজ বুগিয়ালে পঞ্চকেদারের অন্যতম মদমহেশ্বর বা মধ্যমহেশ্বরের প্রাচীন মন্দির, তার একপাশে বুড়ো মদমহেশ্বরের খাড়া সবুজ ঢাল আর অন্যদিকে নাম না জানা এক ঝাঁক তুষারশৃঙ্গ, আকাশ-বাতাস এক স্নিগ্ধ পবিত্রতায় মাখামাখি। পরিষ্কার হল উপনিষদের শ্লোকের ব্যাখ্যা – সত্য, সুন্দর আর শিব একই।
এই রে! শেষের ঘটনা আগে বলে ফেললাম! এই লেখাটা বরং শুরু করা উচিত ছিল মে মাসের শেষের দিকের কোন এক সময় থেকে। বেজায় গরম পড়েছে তখন কলকাতায়। অফিস ছুটির পর চায়ের আড্ডায় আমরা একমত হলাম যে অক্টোবরের ট্রেকিং-এ মদমহেশ্বরেই যাওয়া যাক এবার। আগেই পড়া ছিল উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মদমহেশ্বর নিয়ে অদ্ভুত সুন্দর লেখা। অবশ্য সময়ের হাত ধরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে ট্রেক রুটের। এখন রাস্তা কঠিন কিছু নয়, গাইডেরও দরকার নেই। ফিবছর প্রচুর মানুষ যান মূলতঃ মদমহেশ্বর মন্দির দর্শনে। এরপর যথাসময়ে ট্রেনের টিকিট কেটে অপেক্ষার পালা। এরই মাঝে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল দুর্গাপুজো। দশমীতে দেবীকে বিদায় জানিয়ে তার পরদিন ঠিক দুপুরবেলা দুগ্গা দুগ্গা বলে কুম্ভ এক্সপ্রেসে উঠে বসলাম।

শেষ আশ্বিনের পড়ন্ত বিকেলে ট্রেনের বাঁদিকের জানলা দিয়ে শিমুলতলার জনমানবহীন উথালপাথাল প্রান্তরে অদ্ভুত সুন্দর সূর্যাস্ত দেখে মনটা ভাল হয়ে গেল হঠাৎ। ভারতীয় রেলের নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়ে কুম্ভ এক্সপ্রেস একেবারে সঠিক সময়ে হরিদ্বার পৌঁছে দিল। স্যাক ঘাড়ে করে প্রথমেই গেলাম পরেরদিন সকাল সাতটার গুপ্তকাশীগামী হিমগিরি এক্সপ্রেস বাসের টিকিট বুক করতে। আমাদের যেতে হবে রাঁশি গ্রাম। হরিদ্বার থেকে সরাসরি রাঁশি পর্যন্ত বাস বোধহয় নেই। তাই গুপ্তকাশী বা গৌরীকুণ্ডগামী যে কোনও বাসে কুণ্ড পর্যন্ত গিয়ে শেয়ার জিপ বা অন্য কোন বাসে রাঁশি চলে গেলেই হবে। বাসের একেবারে সামনের দিকের সিট বুক করে বিজয়ীর আনন্দ নিয়ে সোজা গেলাম বিষ্ণুঘাটের কাছে ভোলাগিরি আশ্রমে। ব্যাগপত্তর রেখে চোখেমুখে জল দিয়ে রাস্তার ভিড় ঠেলে সোজা ছুট হর কি পউরি ঘাটের দিকে, যা বহুবার দেখেও পুরনো হবার নয় – সেই গঙ্গা আরতি দেখতে।

পরদিন সকালে ঠিকসময়ে হরিদ্বার ছাড়ল বাস। জানলার পাশে বসে হাওয়া খেতে খেতে প্রকৃতি দর্শনের আশা উবে গেল অচিরেই, হৃষীকেশ পেরনোর ঠিক পরেই। চারধাম মহামার্গ বিকাশ পরিযোজনায় রাস্তার কাজ চলছে জোর কদমে, কাটা পড়ছে পাহাড়, গুঁড়িয়ে যাচ্ছে পাথর। এই উন্নয়নের ঠেলায় ধুলোয় ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ, বাস চলছে ঢিমে তালে। সর্বাঙ্গ ধুলোয় ধূসরিত হয়ে যখন কুণ্ড নামলাম তখন বিকেল চারটে বেজে গেছে। আমাদের ফেলে রেখে বাস চলে গেল গুপ্তকাশী হয়ে গৌরীকুণ্ডের দিকে। আমরা যাব উখিমঠ হয়ে রাঁশি গ্রাম, আরও প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার রাস্তা। খানিক পরেই রাস্তায় ধুলোর ঝড় উড়িয়ে এক বাস এল রাঁশি যাওয়ার। বেশ ভিড়, বসার জায়গা নেই। কনডাক্টর দাদা আশ্বাস দিলেন উখিমঠ গেলেই বসার জায়গা পাওয়া যাবে। সেই বাস থামতে থামতে যখন মনসুনা, উনিয়ানা হয়ে রাঁশি পৌঁছাল তখন ঘোর অন্ধকার চারিদিকে। সামনে যে থাকার আস্তানা পেলাম ঢুকে পড়লাম সেখানে। থাকার ব্যবস্থা খুবই সাধারণ, তাতে অবশ্য কোনও অসুবিধা নেই। গরম জল জোগাড় করে সারা দিনের ধুলোময়লা ধুয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে হেডটর্চ জ্বেলে চলে গেলাম রাঁশির বিখ্যাত রাকেশ্বরী মন্দির দেখতে। গাড়োয়ালের আর পাঁচটা প্রাচীন মন্দিরের মত একই গঠনশৈলী। এতক্ষণে বেশ ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে। মাথার ওপর প্রায় গোল চাঁদ উঠে পড়েছে, দুদিন পরেই কোজাগরী পূর্ণিমা, মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশ। ভাত, ডাল, আলুর তরকারি আর ডিমের ওমলেট দিয়ে জমিয়ে রাতের খাওয়া সেরে যখন মোটা কম্বলটা গায়ে টেনে নিলাম তখন গোটা রাঁশি গ্রাম একেবারে নিঝুমপুর।
পরদিন সক্কাল সক্কাল রেডি হয়ে গেছি তিনজন। রোগা চেহারা আর হাসি হাসি মুখ নিয়ে হাজির হয়ে গেছে মহাবীর। বলতে ভুলে গেছি, এই পথে কোনও গাইড দরকার না থাকলেও, আমার এক বন্ধু কমল সিংহ পানোয়ার বলে একজনের ফোন নাম্বার দিয়েছিল, বলেছিল –"পারলে ওকে নিস, স্থানীয় মানুষের রুটি রুজিরও তো দরকার আছে"। একেবারে হক কথা। তো সেই কমল পানোয়ার এখন গাইডের কাজ ছেড়ে উখিমঠে এক মোটর গ্যারাজে কাজ করে, সেই পাঠিয়েছে তার ভাই মহাবীরকে। হাঁটা শুরু করলাম যখন, ঠিক আটটা। পিচঢালা রাস্তাটা এখন রাঁশি ছাড়িয়ে আরও এক কিলোমিটার এগিয়ে গেছে, চাইলে এই রাস্তাটুকুও গাড়িতে যাওয়া যায়। আমরা তিনজন অবশ্য হেঁটেই চলেছি। এই পাকা রাস্তার শেষে প্রথম বার দেখা গেল চৌখাম্বাকে, নীল আকাশের গায়ে রাজকীয় ভঙ্গীতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মহাবীর বলে, ভাল করে দেখে নিন, এর দেখা আবার পাবেন একেবারে বুড়ো মদমহেশ্বর গিয়ে। এবার শুরু হল উতরাই পাহাড়ি পথ। একটা বাঁকের মুখে হারিয়ে গেল চৌখাম্বা আর পিছনে পড়ে থাকল ছবির মত সুন্দর রাঁশি গ্রাম।

হাঁটছি এবার উতরাই পথ ধরে। তারপর যেতে যেতে যেতে, অনেক নিচে বয়ে যাওয়া এক নদীর সঙ্গে দেখা। নাম তার মধু গঙ্গা বা মদমহেশ্বর গঙ্গা। উল্টো দিকের পাহাড় বেয়ে নেমেছে বড়সড় এক ঝরনা। চারপাশে ঘন জঙ্গল, গাছে গাছে নাম না জানা ছোট ছোট পাখির কিচিরমিচির – সব মিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ। এই ভাবে ছয় কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে কখন যে ছোট্ট গ্রাম গোন্ডার পৌঁছে গেলাম খুব একটা টের পেলাম না। একটা খাবারের দোকানে আলুর পরোটার অর্ডার দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসলাম। মহাবীরের বাড়ি এই গোন্ডার গ্রামেই। সে একবার চট করে বাড়িতে দেখা করে আসতে গেল। এরপর কিলোমিটার খানিক যেতে না যেতেই এসে গেল লোয়ার বানতোলি। এই ট্রেক রুটের অন্যতম সুন্দর জায়গা বানতোলি। দুপাশ থেকে দুটো নদী – মার্কণ্ডেয় গঙ্গা আর মধু গঙ্গা এসে মিশেছে এখানে, উদ্দাম গতিতে বয়ে চলেছে সেই মিলিত জলরাশি। চারপাশে লাল হয়ে আছে রামদানার খেত। বহু প্রাচীন লোহার ব্রিজ পেরিয়ে পিঠে ঘাসের বিপুল বোঝা নিয়ে চলেছে গাড়োয়ালি মহিলারা। চোখে পড়ল নদীর পাশে ছোট্ট একটা থাকার জায়গা, অবাক হয়ে দেখলাম তোবড়ানো টিনের সাইনবোর্ডে ট্যারাবাঁকা অক্ষরে বাংলায় লেখা আছে হোটেলের নাম - "আশুতোষ লজ"! মনে পড়ল বানতোলির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এখানে কোথাও একটা বাড়ি করেছিলেন। সেই বাড়ি অবশ্য আগেই বিলীন হয়ে গেছে মহাকালের গর্ভে। অংশুমানদা বলল, "বুঝলি, ফেরার সময় এইখানে একরাত থাকব।"
লোয়ার বানতোলির পর থেকে রাস্তাটা পুরোপুরি চড়াই। এরপর এসে পড়লাম কয়েকটা থাকার জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা আপার বানতলি। এবার খেয়াল করলাম আকাশের নীল রং মুছে দিয়ে হানা দিয়েছে জলভরা কালো মেঘের দল। মেঘ-কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারপাশ। ঠিক করেছিলাম আজ যতটা পারি এগিয়ে যাব অন্তত নানু চটি পর্যন্ত তো যাবই। তাই যতটা দ্রুত সম্ভব এগতে লাগলাম। এদিকে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। মহাবীর আশ্বাস দিল চিন্তার কিছু নেই আর একটু ওপরে উঠলে একটা টিনের শেড আছে, ওখানে দাঁড়ানো যাবে। আর একটু চড়াই ভেঙে উঠে ঢুকে পড়লাম সেই আশ্রয়ে আর ঠিক তক্ষুনি তুমুল বৃষ্টি নামল আকাশ ভেঙে। বৃষ্টিটা চলল ঠিক একঘণ্টা, তারপর যেভাবে হঠাৎ এসেছিল, সেই ভাবেই থেমেও গেল। আবার পথে নেমে পড়লাম।
বোধহয় দু কিলোমিটার আরও হেঁটেছি, চোখে পড়ল দুটো কী তিনটে ঘর নিয়ে একটা থাকার আস্তানা। বোঝা গেল খাদারা খাল এসে গেছি। দুপা এগিয়ে টিনের চাল দেওয়া আরও একটা মাথা গোঁজার ঠাই, এখানেও দুটো ঘর। আমরা এসব পেরিয়ে এগিয়েই যাচ্ছিলাম। এমন সময় মহিলা কণ্ঠস্বর শুনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। "আইয়ে, চায়ে পিকে যাইয়ে…" - এক অল্পবয়স্ক গাড়োয়ালি দিদি ডাকছেন আর তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আছে বছর তিনেকের এক ফুটফুটে মেয়ে। সেই মিষ্টি মেয়ের নামটাও জেনে গেলাম –অংশিকা । বৃষ্টির পর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল, প্রাণটা চা-চা করছিল অনেকক্ষণ ধরে। সামনে পাতা নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চে বসে পড়লাম। পকেট থেকে চকলেট বার করে অংশিকাকে দিলাম, হাসিতে ভরে উঠল মুখ। মুহূর্তে আলোয় আলো হয়ে গেল চারদিক। দেখলাম মেঘ সরে গিয়ে দিব্যি রোদ্দুর উঠেছে। সামনে সোজা বেশ কিছু তুষারশৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। মহাবীর বলে চলে, "ওইদিকেই নন্দীকুণ্ড, কাচনি খাল, সুজল সরোবর। আর ডানদিকের জঙ্গলে ঘেরা উঁচু পাহাড়টা দেখছেন? ওইখানে বিসুরি তাল।" জানতাম মদমহেশ্বর ছুঁয়ে অনেকগুলো বিখ্যাত ট্রেক রুট চলে গেছে, তার বেশিরভাগই কঠিন ট্রেক, কিছু তো আবার চ্যালেঞ্জিং ট্রেক। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে চারপাশটা দেখতে থাকি। বৃষ্টির পর আশেপাশের উঁচু পাহাড়গুলোতে বরফ পড়েছে, আলতো রোদ্দুর চুঁইয়ে পড়ছে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে, এদিক-ওদিক দু চারটে বুনো ফুল ফুটে আছে, দূরে কোথাও পাখি ডাকছে… ভারি শান্ত, নিরুপদ্রব জায়গা এই খাদারা খাল। তিনজনেরই বড় ভালো লেগে গেল । ঠিক করলাম, আজ আর এগিয়ে কাজ নেই। এখানেই থাকব। চারপাশ ঘুরে, থাকার আস্তানায় ফিরে দেখি অবাক কাণ্ড। ঘরের সামনে পাথরের চাতালে রোদ্দুর এসে পড়েছে আর সেখানে প্লাস্টিক শিটের উপর শোয়ানো আছে এক ছোট্ট শিশু। জানা গেল দিদির এই ছেলের বয়স সবে তিনমাস। হাত-পা ছুড়ে আপন মনে খেলা করতে থাকে দেবভূমির এই দেবশিশু। অবাক হয়ে যাই শুনে যে এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় তিন বছরের শিশুকন্যা আর তিনমাসের সদ্যোজাত শিশুপুত্রকে নিয়ে একা থাকেন দিদি। রান্না করেন, জল আনেন, অতিথি দেখভাল করেন। তাঁর স্বামী রুদ্রপ্রয়াগের দিকে কোন এক দোকানে কাজ করেন। দিদিদের বাড়ি গোন্ডার গ্রামে – এখান থেকে চার কিলোমিটার দূর। আর কয়েকদিন পর মদমহেশ্বর মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে, তখন তিনি হোটেল বন্ধ করে পুত্রকন্যা নিয়ে গোন্ডার গ্রামে ফিরে যাবেন।

দেখতে দেখতে ফুরিয়ে আসে দিন, ক্রমশ চেপে ধরে প্রবল ঠাণ্ডা, স্পষ্ট হতে থাকে কাছাকাছি কোনও ঝরনার আওয়াজ, একঘেয়ে সুরে ডাকতে থাকে ঝিঁঝিঁ। একসময় উঠে পড়ে কোজাগরী পূর্ণিমার আগের দিনের গোল চাঁদ। মায়াবী আলোতে ভেসে যেতে থাকে নিঝুম চরাচর। এরই মাঝে দিদি যত্ন করে বানান রুটি, ডাল আর আলুর তরকারি। কাঁপতে কাঁপতে খাওয়া শেষ করে লেপের মধ্যে ঢুকে পড়ি। কালই পৌঁছে যাব মদমহেশ্বর… সারাদিনের ক্লান্তির পর কখন যেন চোখের পাতা বুজে আসে।
সব পাহাড়ে সব সকালগুলো মোটামুটি একইরকম হয়। মাথার ওপর বিশাল আকাশটা ঘন নীল রং ছড়াতে থাকে, নরম সোনালি রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়ে আনাচে কানাচে আর কনকনে ঠাণ্ডা লেপ্টে থাকে সারা গায়ে। এমনই সকালে চা খেয়ে আবার পথে নেমে পড়লাম। কালকের থেকেও উৎসাহ আজ অনেক বেশি। চড়াই পথ বেয়ে হাঁটতে থাকি তিনজন। পথ ভালোরকম চড়াই হলেও সুন্দর ভাবে পাথর দিয়ে বাঁধানো। রাস্তায় খুব বেশি ট্রেকার চোখে পড়েনি, বরং পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে গলায় বাঁধা ঘণ্টার টুং টাং শব্দে ঘোড়া চলাচল করছে। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে অনেকে চলেছেন মদমহেশ্বর। এমনই কাউকে বোধহয় মদমহেশ্বর নামিয়ে খালি ঘোড়া নিয়ে ফিরে আসছিলেন শিব সিংহ পানোয়ার। ফেরার পথে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে মৌজ করে বিড়িতে সুখটান দিচ্ছিলেন। আলাপ করায় একগাল হেসে উঠলেন। জানালেন চারটে ঘোড়া ছাড়াও ওনার এক হোটেল আছে লোয়ার বানতোলিতে, একদম লোহার সেতুর কাছে, নদীর পাশে –আশুতোষ লজ, ফেরার সময় ওখানে থাকলে উনি খুব যত্ন করবেন। নিজের খেতের সবজি রান্না করবেন। আমরা তিনজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম, এ যে একেবারে টেলিপ্যাথি! কালই আসার সময় অংশুদা বলেছে ফেরার সময় ওখানেই থাকব। সমস্বরে বললাম আমরা আগামীকালই যাচ্ছি আপনার ওখানে। খুশিতে শিব সিংহ পানোয়ার বিড়ি ফেলে ঘোড়া নিয়ে ফেরার পথ ধরলেন। যেতে যেতে আবার বলে গেলেন – আসবেন কিন্তু বাবু, দেখবেন কেমন যত্ন করি আপনাদের।

খাড়া চড়াই পথ বেয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম নানু চটি। একটাই মোটে থাকার আস্তানা, আশেপাশে ঘন জঙ্গল। গরম ম্যাগি আর চা দিয়ে এখানে ব্রেকফাস্ট সারা হয়ে গেল, আর সেই সাথে বাড়তি পাওনা একটু বিশ্রাম। এরপর জঙ্গল আরও ঘন হয়ে এল। চারপাশে কেমন যেন একটা গা ছমছমে ভাব। মহাবীরকে বলা হল সঙ্গে হাঁটতে। এইভাবে চলতে চলতে পেরিয়ে গেলাম এই পথের শেষ চটি। এবার সামনে শুধু মদমহেশ্বর। এতক্ষণ চড়াই ভেঙে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। প্রতিবার বাঁক ঘুরতেই মনে হচ্ছে এবার বুঝি এসে গেছি মদমহেশ্বর। জানি, মহাবীরকে জিজ্ঞাসা করে বিশেষ লাভ নেই। জিজ্ঞাসা করলেই ভদ্রলোকের মত এক কথাই বলবে- "ব্যাস্, থোড়াসা আগে"। তারপর একসময় সত্যিই এক পাকদণ্ডীর শেষে চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ক্যানভাস। তারপর সেই ক্যানভাসে একে একে ফুটে উঠতে লাগল প্রায় সমতল এক সবুজ ঘাসের গালিচা, গাড়োয়ালি গঠনশৈলীতে তৈরি এক প্রাচীন মন্দির, বাঁদিকে বুড়ো মদমহেশ্বরের একদম খাড়া ঢাল আর ডানদিকে গভীর খাদের ওপারে বেশ কিছু বরফমাখা অনামী শৃঙ্গ, আর মাথার উপর ঘন নীল আকাশ।

পিঠ থেকে স্যাক খুলে সবাই বসে পড়লাম ঘাসের উপর। আঃ ! শান্তি। পৌঁছে গেছি মদমহেশ্বর, পঞ্চকেদারের অন্যতম কেদার যার উচ্চতা সাড়ে এগারো হাজার ফুটের মত। পরিবেশ অদ্ভুতরকম শান্ত, কেবল হাতেগোনা কয়েকজন মানুষের উপস্থিতি। সব মিলিয়ে জায়গাটাতে একটা স্নিগ্ধ পবিত্র ভাব অনুভব করা যায় সহজেই। তার ওপর আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। মন্দিরের আশেপাশে অল্প কয়েকটা ছোটখাটো থাকার জায়গা। তারই একটাতে ঢুকে স্যাক রেখে চলে গেলাম পুজো দিতে।

দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা অবশ্য অন্যত্র। এখানে নাকি নিয়ম থাকার জায়গা যাত্রীরা নিজেদের পছন্দমত ঠিক করতে পারবে, কিন্তু কোথায় খাবে তা নাকি কী এক কমিটি ঠিক করে দেবে। যাক, এখানেও সিন্ডিকেট ঢুকে পড়েছে তাহলে। তা, রোদে বসে ভাত, ডাল আর শাক সিদ্ধ তৃপ্তি করেই খেলাম। খেতে খেতে সামনে বুড়ো মদমহেশ্বর ওঠার খাড়া ঢালটা চোখে পড়ে। আগামীকাল শেষ রাতে উঠতে হবে এই ঢাল বেয়ে, পৌঁছাতে হবে সূর্যোদয়ের আগেই। একনজরে দেখলেই বোঝা যায় কাজটা খুব একটা সোজা নয়। এখন প্রার্থনা একটাই – কাল ভোরে যেন আকাশ সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত থাকে।
সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে কাঁপুনি শুরু হল হি হি করে। এতটাই ঠাণ্ডা যে মন্দিরে সন্ধ্যারতি দেখতে যাওয়ার মত সাহস কারও হল না। কোনোরকমে রাতের খাবার গলাধঃকরণ করে যখন শুয়ে পড়লাম তখন সবে সাড়ে সাতটা বাজে।

ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ করে। দরজার ফাঁক দিয়ে বরফ ঠাণ্ডা হাওয়ার সঙ্গে চাঁদের আলোও এসে পড়েছে মেঝের ওপর। ঘড়িতে সময় সাড়ে তিনটে। এমনিতে চারটের সময় অ্যালার্ম দেওয়া ছিল। ঝটপট উঠে রেডি হয়ে নিলাম। যেখানে যত জল ছিল সবার ওপরেই কাচের মতো পাতলা বরফের আস্তরণ পড়েছে। খানিক পরেই মহাবীরের গলা, "দাদা, চলিয়ে।" কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে এক অপার্থিব সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে চারপাশে। মনে হচ্ছে মহাবীরের পিছু পিছু এক রূপকথার দেশে চলেছি আমরা তিনজন।

মন্দিরকে পাশ কাটিয়ে বামদিকের খাড়া ঢালে উঠতে থাকি একে একে। মহাবীর আগে আগে গিয়ে পথ দেখাতে থাকে। কাল পথ যতটা কঠিন বলে মনে হচ্ছিল, এখন অতটা কঠিন লাগছে না। ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে থাকি। ক্রমে চাঁদের আলোয় দেখা নিচের মদমহেশ্বর মন্দির ছোট হতে থাকে। আমরাই বোধহয় প্রথম যাত্রী বুড়ো মদমহেশ্বরের। বহু নিচে আরও কিছু টর্চের আলো দেখা যায়, বোঝা যায় অন্যরাও এবার হাঁটা শুরু করেছে। আরও বেশ খানিকটা ওপরে উঠতে, প্রথমবার চোখে পড়ল চৌখাম্বা, চাঁদের আলোয় রুপোর মত চকচক করছে তার সারা শরীর। ব্যস! বাকি পথটুকু একরকম লাফিয়ে শেষ করে যেখানে পৌঁছালাম, সেটা প্রায় সমতল বিশাল এক তৃণভূমি, গাড়োয়ালি ভাষায় যাকে বলে বুগিয়াল। এখনও সূর্য উঠতে বেশ কিছুটা সময় বাকি। শেষরাতে কোজাগরী পূর্ণিমার ডুবুডুবু চাঁদ পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মত উজাড় করে দিচ্ছে জ্যোৎস্না, আর সেই স্নিগ্ধ মায়াবী আলোতে ধুয়ে যাচ্ছে চারপাশ, ভেসে যাচ্ছে চৌখাম্বা, ভেসে যাচ্ছে বিশ্বচরাচর।

বুগিয়ালের মাঝখানে পাথরের তিন দেওয়ালের মাঝে শিবের ছোট্ট আশ্রয় স্থল। ইনিই বৃদ্ধ মদমহেশ্বর। সামনে ছোট্ট জলাশয়। এই কনকনে ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে গেছে তার জল। এর নাম ব্যাস কুণ্ড। বরফ হয়ে গেছে ঘাসে পড়া রাতের শিশিরও। সেই জন্য গোটা বুগিয়ালের রং এখন সবুজের পরিবর্তে সাদাটে লাগছে। উত্তর দিকে যেখানে এই বুগিয়ালের শেষ, সেই দিকেই আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চৌখাম্বা। এতটাই কাছে, মনে হয় যেন জোরে ঢিল ছুড়লে ঠিক গিয়ে পড়বে। তারপাশে দুই শৃঙ্গ বিশিষ্ট মান্ধানি পর্বত, আর পশ্চিম দিকে বেশ কিছুটা দূরে উকি দিচ্ছে কেদার ডোম। এই সবই দেখছি চাঁদের আলোতে। জ্যোৎস্না যে এত ফুটফুটে হতে পারে আগে জানতে পারিনি।
ক্রমে ক্লান্ত চাঁদ ডুবে গেল পাহাড়ের আড়ালে, আর ঠিক একই সময়ে সোনালি রং ধরল চৌখাম্বার চূড়াতে, তারপর সে রং ছড়িয়ে পড়ল কেদার ডোমে। অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছি সবাই। কানে যেন পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি – ওঁ মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ...বাতাস মধু বহন করছে, নদী সিন্ধু সকল মধুক্ষরণ করছে। ওষধি বনস্পতি সকল মধুময় হোক। রাত্রি মধু হোক, ঊষা মধু হোক, পৃথিবীর ধূলি মধুময় হোক। সূর্য মধুময় হোক"।

যখন আবার নেমে এলাম মদমহেশ্বর, সোনালি রোদ্দুরে ভেসে আছে চারপাশ। ম্যাগি আর চা খেয়ে পিঠে স্যাক নিয়ে ফেরার রাস্তা ধরলাম। একটু এগোতেই পথের বাঁকে হারিয়ে গেল মদমহেশ্বর মন্দির। আজ আমাদের সোজা গন্তব্য বানতোলির আশুতোষ লজ। উতরাই পথে গল্প করতে করতে তিনজন পৌঁছে যাই লোয়ার বানতোলি। আমাদের দেখে একগাল হেসে ওঠেন শিব সিংহ পানোয়ার। স্ত্রী, সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ পুত্র আর চারটে ঘোড়া –এই নিয়ে সুখের সংসার শিব সিংহজির। আমাদের চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখান। একেবারে ছবির মতো জায়গা। বাড়ির সামনে দিয়ে উদ্দাম গতিতে বয়ে চলেছে চৌখাম্বার দিক থেকে আসা মার্কণ্ডেয় গঙ্গা, আর পিছন দিকে নন্দীকুণ্ড থেকে উৎপন্ন মদমহেশ্বর গঙ্গা বা মধু গঙ্গা। কাছেই মধুগঙ্গা পার করার লোহার ব্রিজ। পাশে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে নানা রকম শাক সবজির চাষ করেছেন শিব সিংহ –কুমড়ো, আলু, টমেটো , মিঠে করলা, লঙ্কা এই সব। তার পাশেই লাল হয়ে আছে রামদানার খেত। কাছেই কয়েকটা আখরোট গাছ। শিব সিংহজি গর্ব করে বলেন, "আমাদের শুধু চাল আর তেল মশলা কিনতে হয়।" দুম করে মনে পড়ে গেল ঊমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কথা। শিব সিংহ জানলেন ওনার পিতাজীর সাথে ওই বাঙালীবাবুর বহুৎ জান পহেচান ছিল। ঊমাপ্রসাদের বাড়ি কোথায় ছিল সেটাও দেখালেন। সে বাড়ির যে সামান্যটুকু অবশিষ্ট ছিল, ২০১৩ সালের বন্যায় সেটুকুও চলে যায় মার্কণ্ডেয় গঙ্গার গর্ভে। কথা বলতে বলতে ঘোড়ায় চেপে মদমহেশ্বর যাওয়ার এক খদ্দের জুটে গেল শিব সিংহ পানোয়ারের। "আপনারা ভালো করে বিশ্রাম করুন, আমি এই যাব আর আসব" – ঘোড়ার পিঠে সওয়ার বসিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অদৃশ্য হলেন শিব সিংহজি।

পরদিন সকালে বানতোলিকে বিদায় জানিয়ে হাঁটা শুরু করলাম রাঁশি গ্রামের দিকে। সেখান থেকে সকাল দশটায় একটাই বাস ছাড়ে রুদ্রপ্রয়াগের উদ্দেশ্যে। ধরতেই হবে সেই বাস। একসময় মদমহেশ্বর ট্রেক রুট পিছনে ফেলে পৌঁছে যাই রাঁশি। ফাঁকা বাসে উঠে বসি। বাস ছাড়ার সময় চলে আসে। মহাবীর বিদায় জানিয়ে বলে, " আবার আসবেন।" হঠাৎ করে মন খারাপ করতে থাকে। বুড়ো মদমহেশ্বরে দেখা সেই অপার্থিব জ্যোৎস্না আর অলৌকিক সূর্যোদয় যা আর জীবনে দেখা হবে না, নাকি খাদারা খালে দেখা তিন বছরের অংশিকা আর তার তিন মাসের ভাই – যারা বড় হবে ভীষণ নির্জনতায় পাহাড়ের কোলে, নাকি মহাবীর, প্লাস্টিকের চটি আর মলিন জ্যাকেট পড়ে সর্বাঙ্গে অভাবের ছাপ নিয়েও যে সব সময় হাসে – কার জন্য এই মন খারাপ ঠিক বুঝতে পারি না। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে বাস এগোতে থাকে।


~ মদমহেশ্বরের তথ্য ~ মদমহেশ্বরের ট্রেকরুট ম্যাপ ~ মদমহেশ্বরের আরও ছবি ~

পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতক পল্লব চক্রবর্তী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাণিজ্য কর দফতরের আধিকারিক। ভালোবাসেন নানা ধরণের বই পড়তে। নেশা ব্যাগ ঘাড়ে করে পরিবারের কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে কাছে বা দূরের ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়া। বেশি পছন্দের পাহাড় আর বন। এক সময় দার্জিলিং-এ চাকরি করেছেন বেশ কিছু দিন। সেই থেকে পাহাড়ের সঙ্গে মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে পড়া।

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher