শ্যামদেশের চাও ফ্রায়া নদী

মার্জিয়া লিপি


২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক রিজিওনাল কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি এ কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন। ইউএসএইড বাংলাদেশ থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত প্রকল্প থেকে মোট আটজন প্রতিনিধি আমরা কনফারেন্সে প্রতিনিধিত্ব করি। সে উপলক্ষ্যেই আমার প্রথমবারের মতো ব্যাংককে যাওয়া। দিনটা ছিল ২৭ অক্টোবর, সময়মতো বিমানবন্দরে হাজির হলাম।
নির্ধারিত সময়ে - থাই এয়ারলাইন্স পাখা মেলে দেয় নীল আকাশে। রোদ ঝলমলে নীলের মাঝে সাদা রঙের পেঁজা তুলার মতো মেঘ ভেসে যায় দূর আকাশে। এয়ার হোস্টেসের হট ক্লিয়ার থাই স্যুপ আর গ্রেপস জুসের উষ্ণ আতিথেয়তা শেষ হতে না হতেই ব্যাংকক সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে পৌছালাম। সেখানে তখন বিকাল পাঁচটা। বাংলাদেশ সময় বিকাল চারটে। আকাশে ভাসতে ভাসতে কখন যেন এক ঘন্টার সময় গরমিল হয়ে যায়। সূবর্ণভূমি বেশ বড় এয়ারপোর্ট। সুসজ্জিত সুবর্ণভুমির আলোঝলমলে করিডোর পেরিয়ে পৌঁছে গেছি এক মাথা থেকে আরেক মাথায়। হাঁটছি, কখনও চলন্ত রাস্তায় এগোচ্ছি। সুন্দর সাজানো – আধুনিক সব ব্যবস্থা। এয়ারপোর্টে ডলার বিনিময় মূল্য কিছুটা কম; থাই মুদ্রা ১ বাথের বিনিময় মূল্য ২.৮ বাংলাদেশি টাকা। মোবাইল ফোনের সিম কিনতে গিয়ে কিছুটা সময় কেটে যায়। ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা সেরে কনফারেন্সে অংশ নিতে আসা সকলেই সাদা একটি মাইক্রো বাসে চড়ে বসলাম। গন্তব্য র‌্যাচাপ্রসং এর হোটেল আনান্তরা সিয়াম।
রাস্তায় কিছুটা যানজট রয়েছে। প্রথমবারের মতো আসা একসময়ের শ্যামদেশ আর বর্তমানে থাইদেশের রাজধানী শহর ব্যাংককে। চারপাশের সবকিছুকেই দেখছি অতি আগ্রহী বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে। বিস্তৃর্ণ খোলা জায়গা রাস্তার দুধারে। পথে পথে অনেক বড় বড় শপিংমল। বহুতল প্রাসাদ আর বাণিজ্যিক ভবন সাজানো রয়েছে রাস্তার দুপাশে - নানারকমের নকশায় শৈল্পিক সাজে। ড্রাইভার চ্যাঙ শেন থাইল্যান্ডের স্থানীয় অধিবাসী। ইংরেজী ভাষায় তেমন স্বচ্ছন্দ নয়; তবে আমাদের সঙ্গে কোনোরকমে ভাববিনিময়ে হোটেল পৌঁছে দেয়। তখন প্রায় ঘড়ির কাঁটায় সময় রাত আটটা। এয়ারপোর্ট সুবর্ণভুমি থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে পাতমে অবস্থিত কনফারেন্সের জন্য নির্ধারিত হোটেলটি। আমাদের থাকার ব্যবস্থা পাঁচ তারকা খচিত হোটেল আনান্তারা সিয়াম-এ। আনান্তারার প্রবেশের পথেই রাখা ভেলভেটের মতো উজ্জ্বল জারুল রঙের অর্কিড। রঙবেরঙের অর্কিডের দেশ থাইল্যান্ড। এই শহরটি শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং দৈব প্রকৃতির মিলিত রূপ। লবির বেগুনী রঙের অর্কিডের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে থাই পোশাকের দুজন গোলাপী চিবুকের মেয়ে অভ্যর্থনা জানায় আমাদের। মোট চার দিনের বুকিং ছিল হোটেল সিয়ামে। যদিও কনফারেন্স শেষের তিন দিন থেকেছিলাম সুকুম্বির হোটেল রিজেন্সিতে। থাইল্যান্ডে ঘুরতে এলে সাধারণত বাংলাদেশিরা সুকুম্বিতে অবস্থান করে। ৫০০/৬০০ বাথ-এ হোটেল পাওয়া যায় এ এলাকায়। সহকর্মী রাজু আমাদের জন্য অনলাইনে হোটেল বুকিং করে রেখেছিল ১২০০ বাথ-এ। পাঁচতারায় থাকার পর পরবর্তী দিনগুলোতে সুকুম্বির হোটেলটিতে স্বাচ্ছন্দ্য ছিল অনেকটাই কম। খুব স্বাভাবিক ভাবেই টাকার মানের সঙ্গে বৈভব আর স্বাচ্ছন্দ্য সম্পর্কিত। ব্যাংককের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও মার্কেটে শপিং করতেই সময় চলে যায়। রাতটুকুই শুধু আমাদের হোটেলে থাকা।

থাইল্যান্ড বা তাইল্যান্ড দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রটির সরকারি নাম তাইরাজ্য (থাই: ราชอาณาจักรไทย রাচ্ ক্সাণাচক থাই অর্থাৎ "তাই রাজ্য")। থাইল্যান্ডের বৃহত্তম শহর ও রাজধানীর নাম ব্যাংকক। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত দেশটি নাম ছিল শ্যামদেশ (থাই: สยาม সায়াম্)। পরবর্তীতে এর নাম বদলে হয় থাইল্যান্ড ।
ব্যাংকক যাত্রার পূর্বে উইকিপিডিয়া আর গুগল থেকে কিছু সাধারণ তথ্য জেনেছিলাম - থাইল্যান্ড একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। সংবিধানে রাজাকে খুব কম ক্ষমতাই দেওয়া হয়েছে, কিন্তু জাতীয় পরিচয় ও ঐক্যের প্রতীক রাজা। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী থাই জাতির মানুষ থাই ভাষাতে কথা বলে। ৫ বর্গ কিমি-র কিছু উপরে ব্যাংককের আয়তন। কৃষি, পর্যটন, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট ব্যাবসা থাই জনগণের। শিক্ষার হার ছেলেদের – মেয়েদের শতভাগের কিছুটা কম। প্রায় সবাই থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম পালন করে। থাইল্যান্ডে বসবাসকারী অন্যান্য জাতির মধ্যে আছে চিনা, মালয় ও আদিবাসী পাহাড়ি জাতি, যেমন মং ও কারেন।
থাইল্যান্ডের মধ্যভাগে রয়েছে একটি বিস্তীর্ণ উর্বর সমভূমি। সমভূমির মধ্য দিয়ে দেশের প্রধান নদী চাও ফ্রায়া এবং এর বিভিন্ন শাখানদী - উপনদীগুলি প্রবাহিত হয়েছে। মধ্য অঞ্চলের উর্বর সমভূমিতে দেশের ধান ও অন্যান্য ফসলের অধিকাংশের আবাদ হয়।
ব্যাংককের প্রথম রাতে আমাদের তেমন কিছুই দেখার সুযোগ হয়নি। হোটেলে চেক ইন করে ডিনার শেষে শুধুমাত্র সিয়াম আনান্তারার থেকে বের হলাম পায়ে হেঁটে একনজরে শহরের রাতের সৌন্দর্য দেখার উদ্দেশ্যে। হোটেলের লবি থেকে সামনের দিকে তাকালেই স্কাইট্রেনের স্টেশন র‌্যাচাপ্রসং। সিয়ামের প্রবেশ পথের শুরুতেই মাথার ওপরে র‌্যাচাপ্রসং স্কাইওয়াক দেখে মনে হলো যাক যেখানেই যাই না কেন অনন্ত স্কাইট্রেনে ফিরে আসতে পারব হোটেলে। নিকটস্থ সিয়াম সেন্টার এবং সিয়াম প্যারাগন মলগুলি রাত দশটায় বন্ধ হয়ে যায় তবে রাতচাপ্রসং মোড়ে ইরাওয়ান মাজার কমপ্লেক্সে টুরিস্টদের ভিড় লেগেই থাকে। হপ্তাখানেক সময়ে দেখা ব্যাংকককে মনে হয়েছে যেন পর্যটকদের মনের মতো হওয়ার জন্যে চারপাশে পশরা মেলে নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে।
বৈচিত্র্যময় আয়োজনের জন্যে ভ্রমণপিপাসুদের পছন্দের তালিকায় অন্যতম থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক। রোমাঞ্চকর ভ্রমণের জন্য থাইল্যান্ডের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। অনেক বড় বড় প্রাসাদ-অট্টালিকার ভিড়, শপিং মল, আকাশছোঁয়া স্কাইট্রেনে চোখের পলকে শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে চলা – এসব কিছুই এ শহরের বৈশিষ্ট্য। শপিং করার জন্য সস্তা কিছু রাতের মার্কেটও রয়েছে ব্যাংককে। কী নেই এই দেশে! আধুনিক শহরের আলোর ঝলকানি থেকে শুরু করে পাহাড়ের ভাঁজে ছোট্ট গ্রাম আর বিশাল সমুদ্রের ঢেউ এর গর্জন, বেলাভূমি, কোরাল দ্বীপ, ওয়াকিং স্ট্রিটে লাইফ ড্যান্স শো, মিউজিক শো, বার, স্ট্রিট ফুড আর ম্যাজিক শো সহ হরেক আয়োজন রয়েছে এ রাজধানীর পথে প্রান্তরে। নির্জন প্রকৃতি ভ্রমণ আর শহুরে হইহুল্লোর সব কিছুর সমাহারে ব্যাংকক সমৃদ্ধ। আর রয়েছে ট্রাফিক জ্যাম। এই একটি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ঢাকা শহরের মিল রয়েছে। পর্যটকদের আকর্ষণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এ শহরের নানা প্রান্তে - বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে – গ্র্যান্ড প্যালেস, সাফারি ওয়ার্ল্ড, চাও ফ্রায়ায় রিভার ক্রুজ, ওয়াট অরুন, ওয়াট ফ্রা কাইয়াগ, লুম্ফিনি পার্ক, বেঞ্চিকিতি পার্ক, চায়না টাউন, ব্যাংককের সর্বোচ্চ ভিউপয়েন্ট মাহানাখোন স্কাইওয়াক, মাদাম ত্যুসো মিউজিয়াম, শাখা নদীতে নৌকায় ভাসমান ফুল ও সবজির বাজার, আয়ুতাহায়া হিসট্রিক্যাল পার্ক ইত্যাদি।
অনেক আকর্ষণের ভিড়ে চাও ফ্রায়া নদীর পারের এলাকাটি পৃথিবীজোড়া পর্যটকদের প্রিয় একটি গন্তব্য। নদী জড়িয়ে থাকা এই শহরটিতে রয়েছে অনেক মন্দির এবং আশ্চর্য সব স্থাপত্য – আয়ুত্থায়া শহর, ব্যাং পা-ইন সামার প্যালেস এবং ওয়াট চাই ওয়াট্টানরম – এরকম নানা কিছুর ঠিকানা। ব্যাংককের বাণিজ্যপথ চাও ফ্রায়া নদী। নদীতে নৌকা বিহারেই এই শহরটিকে সবচেয়ে ভালভাবে দেখা যায়। বিকেল থেকেই এখানে জমতে শুরু করে দশনার্থীদের ভিড়। হই-হুল্লোড় লাইভ মিউজিক, ক্লাবিং, নাইট শপিং চলে গভীর রাত অবধি।
ব্যাংকক থেকে চাও ফ্রায়া নদীর ধারে গড়ে উঠেছে পর্যটন এলাকা এশিয়াটিক দ্য রিভারফ্রন্ট। পূর্বে ইস্ট এশিয়াটিক কোম্পানির ডক হিসেবে ব্যবহৃত হত এ ঘাট। ২০১১ সালে রিয়েল এস্টেট কোম্পানি টিসিসি ল্যান্ড এ স্থানটিকে বিনোদন এবং পর্যটনের জায়গা হিসেবে গড়ে তোলার দ্বায়িত্ব নেয়। নতুন করে সংস্কার করে এই এলাকা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। উনিশ শতকের শুরুর কিছু আগেই ডেনমার্কের ইস্ট এশিয়াটিক কোম্পানি থাইল্যান্ডের প্রদেশ সিয়ামের সঙ্গে বাণিজ্য স্থাপনের জন্য এ ডক তৈরি করে। চাও ফ্রায়া নদীকে কেন্দ্র করে এই কোম্পানি বাণিজ্য ঘাঁটি গড়ে তোলে। নদীর দুই কিনারে গড়ে ওঠে নয়ানাভিরাম বিভিন্ন স্থাপত্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব পর্যন্ত এখানেই বাণিজ্য চলে।
এশিয়াটিক স্কাই রাউন্ডে চড়ে চাও ফ্রায়া নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এখনও নদীর ঘাটে ডেনিশ স্থাপনার মতোই বিভিন্ন ডেক রয়েছে। নদীর পাড়ে কাঠের ডেকে হেঁটে বেরিয়ে নদীর দুপাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর আলোকসজ্জায় চাও ফ্রায়ায় স্নিগ্ধ সন্ধ্যার রূপ যেন, আলো ঝলমলে। নৌকাবিহারেই রয়েছে ক্যালিপসো শো। এই শোতে থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী নাচগুলো প্রদর্শন করা হয়। সব বয়সীদের জন্য রয়েছে নানা ধরনের রাইড।
ইচ্ছে করলে সারাদিন কাটিয়ে দেওয়া যায় প্যালেস চত্বরে। চায়না টাউন পেরিয়ে চাও ফ্রায়া রিভার সাইডে। সমস্ত নগর নদীর মতো চাও ফ্রায়ার ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে রাজধানী ব্যাংককের ইতিহাসের সঙ্গে। চাও ফ্রায়া নদীর পূর্ব পাশ দিয়ে খাল খনন করে একটি কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করা হয়। ব্যাংকককে অভিহিত করা হয় 'প্রাচ্যের ভেনিস' নামে। পাশ্চাত্যের খ্যাতনামা অনেক লেখক চাও ফ্রায়াকে দূর প্রাচ্যের অন্যতম প্রিয় জায়গা বলে অভিহিত করেন। ব্যাংককের মাঝখান দিয়ে চাও ফ্রায়া নদী বয়ে গেছে। নদীর একপাড়ে ওয়াট ফো আর অন্য তীরে ওয়াট অরুণ। অসম্ভব শৈল্পিক কারুকাজ জড়িয়ে রয়েছে মন্দিরের গায়ে গায়ে। সংস্কার কাজের জন্য বড় চূড়াটি ঢেকে রাখা। বনসাই দিয়ে বিভিন্ন নকশা করে রাখা মন্দিরের বাইরের চত্বরটি। সন্ধ্যায় বিভিন্ন সময় ধরে রিভারক্রুজ চলে – দুইতলা একটা জাহাজের মতো। নির্ধারিত সিটে বসার পর যাত্রা শুরু করে ঘড়ির কাঁটা মেনে। কী নেই সেখানে – ক্যাফে, আলো ঝলমলে মার্কেট, লাইভ মিউজিক আর সঙ্গে বুফে খাবার। দুপাশের রাতের ব্যাংকক দেখতে দেখতে জাহাজ এগোতে থাকে রাজহংসীর মতো ডানা মেলে। পুরো জলবিহারই যেন রঙ-বেরঙের আলোর বুক চিরে এগিয়ে যায়। দুপাশের স্থাপনার ঝলমলে আলোর প্রতিফলনে চারপাশকে মনে হয় স্বপ্নপুরী। চাও ফ্রায়া নদীর বুকে প্রায় দেড় ঘন্টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার তীরে ভিড়ল। সেখান থেকে ব্যাংককের জ্যাম ঠেলে হোটেল পৌঁছাতে শরীরে টের পাই ক্লান্তির অবসাদ ।

এর মধ্যেই সুকুম্ভিতে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে রিভার প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয়। পাশের রেস্তোরাঁয় গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম মাইক্রোবাসের জন্য। সন্ধ্যার আগেই মাইক্রোবাস এল। আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েকজন ছিলেন। রাতের ঝলমলে শহর দেখতে দেখতে ড্রাইভার বিশাল ষোলতলাবিশিষ্ট কার পার্কিং-এর ষোল তলায় মাইক্রোবাসটি রাখলেন। সেখান থেকে তিনি আমাদের একটি শপিংমলে নিয়ে গেলেন।
তখন বিকেল পাঁচটা। ড্রাইভার আমাদের চারটি টিকিট দিয়ে বললেন সাতটার দিকে শপিংমলের পাশে অবস্থিত রিভার পোর্টে পৌঁছে যেতে। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম চারপাশ দেখতে দেখতে। সাতটার সময় পোর্টে চলে গেলাম। এরপর দেখলাম বিশাল আকারের একটি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে যার নাম 'সিলভার মুন'। রাতের আঁধারে নদীর ওপরে সাদা আর নীল রঙের মিশেলে জাহাজটি ছিল অপূর্ব সুন্দর, সঙ্গে ছিল পুরো জাহাজ জুড়ে সাদাটে-নীলচে রঙের মরিচবাতি যা সত্যিই মন ছুঁয়ে যায়। যেন স্বপ্নের আলোর পথে আমি উঠছি।
জাহাজটি ছিল তিনতলাবিশিষ্ট। তিনতলায় উঠে বসি। ওঠার সময় জাহাজের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কেবিন ক্রুরা অভ্যর্থনা জানায়। একদম ধারের দিকে একটি টেবিল আমি আর সহকর্মী বেছে নিই। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দে চারপাশের নীরবতা বিদীর্ণ হয়। কী যে ভালো লাগছিল রাতের শহরটিকে জাহাজে করে দেখতে! এর আগে আমার কখনও শহরের মাঝখান দিয়ে এরকম পরিবেশে 'রিভার ক্রুজ' ভ্রমণের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না।
নদীর দুধারেই আকাশচুম্বী অট্টালিকা আর আলো এবং মাঝখানে নদী। বাইরের অট্টালিকাগুলোর আলো, জাহাজের সাদা-নীল আলো আর আকাশের চাঁদের আলো সব মিলিয়ে এ ছিল এক অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতি। জাহাজের ভিতরে লাইভ কন্সার্টের আয়োজনও ছিল। গান শুনতে শুনতে পরিবেশটা উপভোগ করছিলাম তবে আমার ভালো লাগছিল আলো- আঁধারি প্রকৃতিতে নদীর চারপাশের নাগরিক আয়োজন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার নিয়ে যেতে বলা হয়। বুফে সিস্টেমের আয়োজনে ঐতিহ্যবাহী থাই খাবারের সঙ্গে মহাদেশীয় অনেক খাবারের সমারোহ। বাদাম সহকারে সালাদ, জাপানি স্যুশিসহ বেশ কিছু থাই খাবার প্লেটে তুলে নিই ডিনারের জন্যে। যদিও থাইল্যান্ডের থাই খাবারের স্বাদ আমাদের দেশের থাই খাবার থেকে একেবারেই ভিন্ন। ডিনারের সঙ্গে উপভোগ করছিলাম কনসার্টের সুর। পাশ দিয়ে আরও অনেক জাহাজ আসা যাওয়া করছিল। ব্যাংককের অনেক বিখ্যাত জায়গাও দেখলাম। নদীর ওপর দিয়ে বেশ কিছু বড় বড় রাস্তাসহ ব্রিজ ছিল। যখনই আমাদের জাহাজটির ব্রিজ অতিক্রম করার সময় হচ্ছিল তখনই মাইক্রোফোনে সতর্ক করা হচ্ছিল কেউ যাতে না দাঁড়ায়, সবাই যেন বসে থাকে।
নদীপথে পুরো ব্যাংকক শহরে ঘুরিয়ে দুঘণ্টা পর জাহাজটি আমাদের আবার সেই শপিংমলের পাশে অবস্থিত পোর্টে নামিয়ে দেয়। স্কাই ট্রেনে ফিরে এলাম হোটেল সিয়াম আনান্তারায়। অসম্ভব সুন্দর একটি সন্ধ্যা কাটিয়ে ছিলাম আমরা।

কৃতজ্ঞতা: আনিসুল হক

লেখক, গবেষক ও পরিবেশবিদ মার্জিয়া লিপি পেশাগতভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চল, জলাশয়, প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় কাজ করেছেন। ব্যক্তিগত আগ্রহ ও কাজের সূত্রে ঘুরেছেন দেশ-বিদেশে । প্রকৃতি আর মানুষের প্রতি বিমুগ্ধতায় নানাসময়ে দেখেছেন চেনা-অচেনা ভূগোল। প্রকাশিত বই - আমার মেয়েঃ আত্মজার সাথে কথোপকথন, একাত্তর মুক্তিযোদ্ধার মা, বাংলাদেশের উপকূল: পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য, শেখ হাসিনার শৈশব-কৈশোর, সম্পাদিত গ্রন্থ: সরদার ফজলুল করিম দিনলিপি, মাঃ দুইবাংলার সাহিত্য সংকলন, শিশু বিশ্বকোষ ইত্যাদি।

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher