এক টুকরো তিব্বত

প্রজ্ঞা পারমিতা


তিব্বত দেখতে ইচ্ছে যায়? গেলেই হয়! ওই তো – কলকেতা, ব্যাঙ্গালোর, মাইসোর, তারপরেই তিব্বত – ব্যাস। হ্যাঁ, একটু অন্য পথে এই যা। এখন আপনি যদি সহসা এক জায়গায় হাজার হাজার তিব্বতিদের একত্র অবস্থান দেখতে পান, পথেঘাটে দোকান-বাজারে সর্বত্র, তাহলে এমন মনে হওয়া একটুও অস্বাভাবিক নয় যে বুঝি বা তিব্বতে হাজির হলাম! শুধু তো মুখ নয় - তিব্বতি বৌদ্ধ মঠ, মন্দির, শিল্পবস্তু, খাদ্য - কী নেই সেখানে! সাধে আমার কর্ণাটকের বায়লাকুপ্পে গিয়ে মনে হয়েছিল এ যেন হযবরল-এ বাতলানো সিধে রাস্তায় তিব্বতে পৌঁছে যাওয়া।
আশপাশের অনেকটা এলাকাসহ এই বায়লাকুপ্পে গ্রামটি হল তিব্বতের বাইরে দ্বিতীয় বৃহত্তম তিব্বতি বসতি, ধরমশালা যেখানে প্রথম। তাই এই অঞ্চলে না জেনে ঢুকে পড়লে চমক লাগবে, মনে হবে দাক্ষিণাত্যের সমতলে এত পাহাড়ি মঙ্গোলীয় ধাঁচের মুখ এল কী করে! একটু খোঁজ নিলেই মুখগুলির পিছনের ইতিহাস স্পষ্ট হবে। ওরা সবাই দেশ-হারানো মানুষ অথবা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম। চিন যখন তিব্বতকে জোর করে বগলদাবা করে নেয়, তখন যে সব তিব্বতি পালিয়ে আসে ভারতে তাদের মধ্যে বহুসংখ্যক মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয় এই বায়লাকুপ্পে এলাকায়। ১৯৯৮ সালের হিসেব অনুযায়ী এখানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার তিব্বতির বাস। ঘর-হারানো মানুষেরা মাথায় মনে স্বদেশের স্মৃতির ভার বয়ে বেড়ায়। একটু থিতু হওয়ার অবসর পেলেই তারা নিজের চারপাশে ফেলে আসা দেশের ছায়ায় ঘরদুয়ার, উপাসনালয় ইত্যাদি গড়ে তোলে। এখানেও তেমনই ঘটেছে। তাদের তৈরি করা অসাধারণ সুন্দর বৌদ্ধ মঠ, ধর্মগুরুর স্মৃতি মন্দির ইত্যাদি কর্ণাটকের পর্যটন মানচিত্রে বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে অতঃপর।
মাইসোর থেকে ঘণ্টা পাঁচেক দূরত্বে কুশলনগর শহর যাকে কেন্দ্র করে বায়লাকুপ্পে ঘুরতে হয়। বায়লাকুপ্পের ভৌগোলিক অবস্থান মহীশুর ও কোদাগু জেলার সীমারেখার উপর। মাইসোর-মারকারা হাইওয়ের উপর টিবেটান সেটলমেন্টটা যে অংশে সেটা মাইসোর জেলায় পড়ে। কিন্তু সেখানে পৌঁছতে গেলে ঢুকতে হবে কুশলনগর দিয়ে যেটা আবার কোদাগু বা সাবেক কুর্গ জেলায়। কুর্গ ভ্রমণার্থীরাই প্রধানত যাতায়াতের পথে নামদ্রোলিং মনাস্ট্রি দেখতে আসেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল দুবার যাওয়ার। প্রথমবার শীতে, দ্বিতীয়বার বর্ষায়। যে কোনও সময় চোখ ধাঁধিয়ে মন ভরিয়ে দেবে এই ঠিকানাটি।
নামদ্রোলিং বৌদ্ধ বিহার চত্বরে ঢুকে অনেকটা উন্মুক্ত পরিসরে দুপাশে কেয়ারি করা বাগান ও সবুজ ঘাসের মাঝখান দিয়ে গিয়ে প্রথমে চোখে পড়বে জাং থো পেলরি মন্দির। হ্যাঁ, এটি মঠ নয় মন্দির যা তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মে স্বর্গের রূপক। আমি যতদূর জানি ভারতে জাং থো পেলরি মন্দির এই একটি মাত্রই আছে। কোনও বৌদ্ধবিহার-সংলগ্ন এই মন্দির একমাত্র নিংমা সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য। বজ্রযান মতাবলম্বীদের বিশ্বাস মহাসিদ্ধ যোগীরা মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মাঝের সময়টা এই স্বর্গে অবস্থান করেন। কথিত যে গুরু পদ্মসম্ভব তিব্বতে তাঁর আরব্ধ কাজ বৌদ্ধধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত করে তাম্র-পর্বতে তাঁর মহিমময় স্বর্গে ফিরে যান। মহাজাগতিক সমুদ্রে এক মণ্ডলাকৃতির দ্বীপে একটি ত্রিতল মন্দিরে তিনি বিরাজ করেন। প্রথমতলে গুরু পদ্মসম্ভব, যাঁর তিব্বতি নাম রিনপোচে। দ্বিতীয় তলে অবলোকিতেশ্বর, যাঁর তিব্বতি নাম চেনরেজিগ এবং সর্বোচ্চ তৃতীয় তলে অমিতাভ বুদ্ধ অবস্থান করেন। জাং থো পেলরি হল সেই স্বর্গীয় মন্দিরের প্রতিরূপ।
দেখলাম মন্দিরের একতলার চারদিকে চারটি প্রবেশ দ্বার। একতলাটি সমবেত ধ্যানের জায়গা রূপে ব্যবহার হয় যদি না বিশেষ কারণে দ্বার রুদ্ধ থাকে। একতলার ওপরে ধাপে ধাপে ছোট হয়ে যাওয়া তিনতলা অপূর্ব কারুকাজ করা প্যাগোডা শৈলীর মূল মন্দির। সবচেয়ে ওপরে একটি রামধনু-রঙা চক্র যার গায়ে অসংখ্য নৃত্যরত মূর্তি। মন্দিরের গাত্রে তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে জড়িত নানা কাহিনি ও চরিত্রের অলংকরণ দেখলাম, দেখলাম বহু সংখ্যক না-মানুষের মূর্তির সারি। আমার একটি স্পোর্টস গ্লাস আছে। সেইটি সম্বল করে বিস্ফারিত চোখে যতটা সম্ভব দেখে গেলাম। নীল, সোনালি ও সামান্য সাদা - তিন রঙের ব্যবহার স্থাপত্যটিকে এমন এক তীব্র সৌন্দর্য এনে দিয়েছে যে প্রথম দর্শনে মনে হয় চোখ দুটি যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে গেল।
আমি প্রথম যেবার যাই, গুরু পেনর রিনপোচের পার্থিব শরীর সমাধিস্থ হওয়ার অপেক্ষায় একতলার কক্ষটিতে রাখা ছিল। সেইসময় সাধারণের প্রবেশ নিষেধ ছিল সেখানে। ২০১৩ সালের ২৩ মে তাঁকে স্তূপ-সমাহিত করা হয়। তাঁর প্রসঙ্গে পরে জানাচ্ছি। দ্বিতীয় ভ্রমণে এই মন্দিরের একতলা উন্মুক্ত পেয়েছিলাম।
মন্দির দেখে আমরা বাঁদিকের পথ নিয়ে চললাম মনাস্ট্রি দেখতে। এই বৌদ্ধমঠটি স্থানীয়দের মুখে মুখে গোল্ডেন টেম্পল নামে খ্যাত। মঠটির বহিরঙ্গে অন্যান্য বৌদ্ধ মঠের মতোই বৌদ্ধ ধর্মের আটটি পবিত্র চিহ্ন চোখে পড়ল। চূড়ায় কলস, পদ্ম ইত্যাদির মোটিফ। চার কোণে ধ্বজ, সামনে ধর্মচক্র যার দু পাশে হরিণ যা সারনাথে বুদ্ধদেবের প্রথম ধর্মসভা বা ধর্মচক্র প্রবর্তনের দ্যোতক। মঠের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ অপার্থিব মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার বিশ্বাস তথাগত, অমিতাভ এবং পদ্মসম্ভবের চল্লিশ ফুট উঁচু তিনটি অপরূপ স্বর্ণময় প্রতিমা প্রত্যেককে প্রথম দর্শনে এমনই মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয় যে কিছুক্ষণ অন্য কোন কথা মনেই থাকে না, অন্য কোন দিকে তাকাতেও দেবে না মূর্তি তিনটি। ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেলাম কাছ থেকে ভালো করে দেখতে। ত্রিমূর্তির মাঝখানে গৌতম বুদ্ধ ভূমিস্পর্শ মুদ্রায়, বাঁহাতে ভিক্ষাপাত্র।

তাঁর ডান দিকে অমিতাভ এখানে অমিতায়ুস রূপে। পরনে রাজবেশ, মাথায় নবপত্রিকার স্বর্ণকিরীট, হাতে অমৃত কলস।

গৌতম বুদ্ধের বাঁদিকে পদ্মসম্ভব বিরাজিত। আমার চোখের সমতলে বলে সবার আগে চোখে পড়ল তাঁর গাম বুটের মতো জুতোটি - বরফের উপর দিয়ে হাঁটার তিব্বতি জুতো। এমন জুতো পরা মূর্তি একমাত্র পদ্মসম্ভব ছাড়া আর কারও হয় না বৌদ্ধ মূর্তিতত্ত্বে। ধর্মপ্রচার করতে তুষারময় তিব্বতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত তিনি পায়ে হেঁটে ঘুরেছিলেন, সামান্য অশ্ব-খুরের মতো স্থানও বাদ না দিয়ে। সে কথা মনে রেখেই পদ্মসম্ভবের এই জুতোপরা মূর্তি সর্বত্র পূজিত হয়। এরপরে চোখ যায় মূর্তির বাঁদিকের বুকের কাছে রাখা বস্তুটির দিকে। একটি বিশেষ ধরনের খট্বাঙ্গ – শৈব কাপালিকদের হাতে যা থাকে তারই রূপান্তরিত তিব্বতি রূপ। একটু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি – একটি ছোট আকারের ত্রিশূল, তার নীচে তিনটি নরমুণ্ড এবং তাতে পাঁচ রঙের সিল্কের ফিতে বাঁধা থাকে। মূর্তির ডান হাতে বজ্র, বাঁ হাতে করোটির অক্ষয় পাত্র। পদ্মসম্ভবের চোখ বিস্ফারিত এবং নাকের নীচে সরু গোঁফ। এই গোঁফ, জুতো আর খট্বাঙ্গ কোন মূর্তিতে একত্রে দেখলে তা পদ্মসম্ভবের মূর্তি বলে চিহ্নিত করা সহজ। মাথার মুকুটটিও বিশেষ, বজ্রের মোটিফ দেওয়া।

দেয়ালে দেয়ালে এবং ছাতেও ছবি ও নানা অলংকরণ দেখলাম। সেখানে ভীষণদর্শন ধর্মপালরা যেমন আছেন, আছেন অন্যান্য বজ্রযানী দেবতারাও। শঙ্খ, ছত্র, মৎস্য ইত্যাদি শুভ চিহ্ন চোখে পড়ল স্থানে স্থানে। স্পোর্টস গ্লাসের কল্যাণে যতটা সম্ভব খুঁটিয়ে দেখলাম, মূর্তি থেকে অলংকরণ সবই। শেষে গ্লাসটি ঝোলায় রেখে ত্রিমূর্তির মধ্যমণি শাক্যমুনির সামনে আবার দাঁড়ালাম গিয়ে। আড়াই হাজার বছর আগের একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। আর তাঁর দুপাশে যে দুজনের মূর্তি তা দৃশ্যত হাতখানেক দূরত্বে হলেও তাঁদের মাঝখানে আছে হাজারটি বছরের তফাত। আছে উৎসের শত যোজন ব্যাপী ভৌগোলিক দূরত্বও। কিন্তু তাঁরা কেমন একত্রে বিরাজ করছেন। ইতিহাস-ভূগোল-ধর্ম-শিল্প সবকিছুর মেল্টিং পট হল সংস্কৃতি। বজ্রযানী সংস্কৃতির বুদবুদে কাটানো সময়টি মনের পটে বাঁধিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে করতে বেরিয়ে এলাম বর্তমান সময়ে। সব সঞ্চয় স্পর্শাতীত ছিল না। তিব্বতি গয়না কিনলাম, তিব্বতি ভোজনেও তৃপ্ত হল উদর।
এত কিছু বলার পরেও কিছু আছে যা না জানলে নামদ্রোলিং বৌদ্ধ মঠটির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা পূর্ণতা পাবে না। এবং বিশেষ একজনের কথা না জানালে আমার ভ্রমণ কাহিনিও সম্পূর্ণ হবে না। তিনি পেনর রিনপোচে। এই মঠের গুরুত্ব বুঝতে চাইলে তাঁর সঙ্গে জড়িত একটি বিশেষ সময়কে একটু ফিরে দেখতে অনুরোধ করব পাঠককে। আসুন না টাইম মেশিনে চড়ে ছয় দশক পিছিয়ে যাই আমরা। মেরুন ও কাষায় বর্ণের বস্ত্র পরিহিত এক তিব্বতি লামা হস্তীযূথ ও চন্দনের বনের জন্য বিখ্যাত কর্ণাটকের এই অঞ্চলে পা রাখলেন। তাঁর সঙ্গী আরও কয়েকজন লামা পিছনে একটু দূরে থেমে গেলেন। একসঙ্গে দলটি এলেও বোঝা যায় প্রথম ব্যক্তিই দলের মস্তিষ্ক এবং হৃদয়। তিনি পেনর রিনপোচে। পেনর বয়সে যুবা, কিন্তু তাঁর জ্ঞানের পরিধি দশকের হিসেবে মাপা যাবে না। বাকি ক'জন তাঁর সশ্রদ্ধ অনুসারী মাত্র। পেনর তাঁর দৃষ্টি বিছিয়ে দিলেন চারিদিকে, যতদূর চোখ যায়। তাঁর দৃষ্টির ভাষা কোন একটি শব্দে ধরা যাবে না। কারণ তাতে শোক আছে, অন্বেষণ আছে, জিজ্ঞাসা আছে এবং আছে বিশ্বাস। কিছুমাত্র দিন আগে তিনি অসম্ভব সব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তিব্বতে তাঁর সাধনার পীঠস্থান হাজার বছরের ঐতিহ্যময় পালয়ুল মঠ ছেড়ে ভারতে এসেছেন। ভারতে প্রবেশ করতে তাঁদের প্রায় তিনশো জন লামার দলটি তিব্বত থেকে অরুণাচল প্রদেশ অভিমুখী পথ নেয়। একে কষ্টবিছানো দুর্গম চড়াই-উৎরাই, তায় পিছনে সততই খ্যাপা কুকুরের মতো চিনা সেনাদের তাড়া ও গুলি বৃষ্টি! এই অভিজ্ঞতা পেরিয়ে আসতে আসতে দলটি হারিয়েছে অধিকাংশ সদস্যকেই। এখন সাকুল্যে তিরিশ জন বেঁচে আছেন। কিন্তু পেনর রিনপোচের দায় যে তাঁর নিজের বা সঙ্গীদের জীবনের চেয়েও বেশি। গুরুশিষ্য পরম্পরায় লব্ধ প্রায় সহস্রাধিক বছরের জ্ঞানের ধারাকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তার স্থান চাই। কোনও বৌদ্ধ মঠ তো যে কোনও স্থানে গড়ে তোলা যায় না! সেই স্থানের কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন। কিন্তু পুনর্বাসনের জন্য ভারত সরকারের দেওয়া এই স্থানে সেইসব বৈশিষ্ট্য না-ও পাওয়া যেতে পারে। তখন পেনর রিনপোচে কী করবেন! ধরমশালা এলাকায় দলাই লামার নেতৃত্বে 'গেলুগ পা' সম্প্রদায়ের প্রাধান্য। কিন্তু তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের প্রাচীনতম উত্তরাধিকার যে পেনর রিনপোচের 'নিংমা' সম্প্রদায়েরই। তিব্বতে বজ্রযানের ভিত্তি যাঁর হাতে, কথিত সেই গুরু পদ্মসম্ভবই 'নিংমা' পরম্পরার আদি পুরুষ। সেই ধারা কি রাজনৈতিক অস্থিরতার বলি হয়ে কালস্রোতে ভেসে যাবে! স্থান পছন্দ না হলে ভারত সরকারকে বলাও যাবে না যে এই জায়গা উপযুক্ত নয়, অন্য জায়গা দিন ধরমশালার মতো। এই দুর্দিনে আমরা-ওরা করাও উচিত নয়, তাছাড়া সর্বোপরি কথায় আছে - ভিখারির নেই চয়নে অধিকার। তাহলে উপায়! অষ্টম শতাব্দী থেকে প্রবাহিত অভঙ্গ 'নিংমা পা' ধারার দীপশিখা দারুণ ঝড়ে নিভে যেতে দেওয়া যায় কি! প্রয়োজনে হাত পুড়িয়েও সে শিখা বাঁচাতেই হবে – এটাই সংকল্প। আর সে কাজ করার যোগ্য লোক পেনর রিনপোচে। তাঁর মতো যুবা বয়সে অগাধ জ্ঞান নিংমা সম্প্রদায়ের আর কারই বা আছে? বজ্রযান দর্শনে পাণ্ডিত্য যদি বা থাকে, তাঁর মতো কঠিন প্রত্যয় আর দুর্জয় সাহস কার? এই অসম্ভব পরিস্থিতিতে দৃঢ়সংকল্প হয়ে এই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া তাঁর পক্ষেই সম্ভব। দুঃসময়ই যে পরীক্ষার সময়।
পেনর রিনপোচে নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে আত্মস্থ হলেন। একে একে স্মরণ করলেন গুরু পদ্মসম্ভবের বজ্রের ন্যায় প্রত্যয়ী 'পদ্মাকর' রূপ, শাক্যমুনি বুদ্ধের ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় সম্বুদ্ধ রূপ, অমিতাভ বুদ্ধের আয়ুপ্রদ অমিতায়ুস রূপ। তারপর চোখ মেলে তাকালেন। দেখলেন মেঘ ছিঁড়ে সূর্যকিরণ তির্যকভাবে পড়েছে সামনের বিস্তৃতিতে। তাতে যেন রামধনুরঙা বীজমন্ত্র চকিতে দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। পেনর রিনপোচের দুচোখ দিয়ে অশ্রুধারা নেমে এল। করুণাময় অবলোকিতেশ্বরকে তিনি লক্ষ কোটি প্রণাম জানিয়ে সেই মুহূর্ত থেকে কাজে লেগে গেলেন।

এবার ফিরে আসি বর্তমানে। আজকের সময়ে বায়লাকুপ্পের নামদ্রোলিং বৌদ্ধ মঠ নিংমা পা সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ মঠ ও শিক্ষা কেন্দ্র। সারা পৃথিবী থেকে শিক্ষার্থী আসেন এখানে বজ্রযান দর্শনের 'নিংমা পা' ধারার পাঠ নিতে। সে পাঠ যেমন নবীন লামারা নিয়ে থাকেন, বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ নিয়ে পড়াশোনা করেন যারা তেমন অনেকেও আসেন। পাঁচ হাজারের মতো বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীর বসবাসের ব্যবস্থা আছে এখানে। মাত্র তিনশো টাকা হাতে নিয়ে পেনর রিনপোচে তাঁর সংকল্পকে বাস্তবায়িত করতে নিজে হাতে জঙ্গল পরিষ্কার করেছেন, মাটি কেটেছেন, কাঠ বয়েছেন। সারা জীবন ধরে ঘুরে ঘুরে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার পাশাপাশি নির্দ্বিধায় প্রার্থী হয়েছেন বিভিন্ন সংস্থা, সম্পন্ন বৌদ্ধ ধর্মানুরাগী বা বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর কাছে। ২০০৯ সালে তাঁর স্বপ্নসম্ভবের মহীরুহ রূপ দেখে তিনি গত হন। ধর্ম সরিয়ে রেখে যদি সাদা চোখেও দেখি, পেনর রিনপোচে যে একজন অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন এই বিষয়ে সন্দেহ নেই। কর্ণাটক পর্যটন মানচিত্রের এই উজ্জ্বল বিন্দুটিকে চাক্ষুষ করতে নামদ্রোলিং মঠের বৃহৎ কর্মকাণ্ড দেখা বা মঠের অপূর্ব স্থাপত্য ভাস্কর্যে মুগ্ধ হওয়ার পরেও কোথাও একটা অসম্পূর্ণতা থেকে যায়, যদি না পেনর রিনপোচের কথা জানি। আমার তাঁকে 'আত্মদীপ ভব' – গৌতম বুদ্ধের এই উপদেশের মূর্ত প্রতীক মনে হয়েছে।

প্রজ্ঞা পারমিতা ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস লিখছেন বছরদশেক। মেডিক্যাল জার্নালিজম করেছেন 'বর্তমান' প্রকাশনার স্বাস্থ্য পত্রিকাতে। 'মাতৃশক্তি' ও 'জাগ্রত বিবেক' পত্রিকার সহসম্পাদক ছিলেন। ইতিহাস ও ঐতিহ্যরক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে কলম ব্যবহার করে থাকেন।

 

HTML Comment Box is loading comments...

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher