আমেরিকার 'কার্নিভাল স্প্লেনডর' ও কলকাতার বনানীদি

বনানী মুখোপাধ্যায়়

~ পুয়ের্তো রিকো, সেন্ট থমাস ও গ্র্যান্ড তুর্ক আইল্যান্ড ক্রুজের আরো ছবি ~

অন্যান্যবারের মত এবারও জুন মাসে পৌঁছলাম আমেরিকায়, ছেলেমেয়ের কাছে। মাসখানেক আনন্দেই ছিলাম হঠাৎই বিনা মেঘে বজ্রপাত। আমাকে নাকি ওদের সঙ্গে ক্রুজে যেতে হবে! সে আবার কী? আমি সেখানে গিয়ে কী করব? সাতদিন সাগরে ভেসে থাকা? ও বাবা, সে আমার দ্বারা হবেনা, আমার তো জল দেখলেও চিত্ত বিকল, না দেখলেও চিত্ত বিকল। কিন্তু আমার চিত্ত বিকলে তাদের চিত্ত বিচলিত হলনা। আমাকে যেতেই হলো।
৫ই অগাস্ট ২০১৩, মনের কষ্ট মনেই রেখে হাজির হলাম নিউ ইয়র্ক বন্দরে। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল এগারতলা জাহাজ। সবাই খুবই খুশি, আর আমি? থাক, সে কথা না বলাই ভালো। জাহাজ ছাড়ল। শুনলাম এই জাহাজের গন্তব্য তিনটি দ্বীপ। আবার তিনটি কেন? একটি দেখে ফিরে এলেইতো হয়। না, তা হবেনা। সবেতেই বাড়াবাড়ি। আমরা ছ'তলার বাসিন্দা হব। উহঃ, ভগবান!
জাহাজের ভেতরে থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা যে সেটা আদৌ চলছে কীনা। আমরা ছ' তলায় আছি, ভেতরটা পাঁচতারা হোটেলের মত। একেবারে ঝলমল ঝলমল করছে। ব্যালকনিতে এসে সমুদ্র দেখছি। য্ত্দূর দেখা যায় জল,জল শুধুই জল। ধীরে ধীরে নিউ ইয়র্ক শহরটা আমাদের চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল। চলে গেল এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার...। মনের ভেতর শুধু দুটি শব্দ ঘোরাফেরা করতে লাগলো 'টাইটানিক' আর 'দেবতার গ্রাস'!
জাহাজের নাম কার্নিভাল স্প্লেনডার। কার্নিভালই বটে। কীযে হচ্ছেনা এর ভেতর তা বলতে পারবনা। শুনলাম এর ভেতরে নাকি সবশুদ্ধু ৩৬০০ লোক। বাপরে, ভাবতে অবাক লাগছিল যে এতগুলো মানুষকে নিজের বুকের ওপর চাপিয়ে জাহাজের একটুও হেলদোল নেই? বলিহারি বাবা! কেমন নিজের মনে গন্তব্যের দিকে চলেছে! এখানকার খাওয়া মানেতো এলাহি ব্যাপার। লাইনে দাঁড়াও আর খাবার নাও, যত পার খাও রকমারি খাবার। রকমারি মানুষ, রকমারি পোশাক, চারদিকে রঙের বাহার,আমার কাছে সবটাই অন্য রকম লাগছে। তিনদিন পর আমরা দ্বীপে নামব। জানিনা, সেখানে গিয়ে কী দেখব।
আজ ৮ই অগাস্ট, একটু পরে আমরা নামব সান জুয়ান, পুয়ার্তো রিকো-তে। বেলা বাড়তেই দুরে সমুদ্রের ওপর দেখা যেতে লাগলো সবুজে কালোতে মেশানো একটা কিছু। না,জাহাজ নয়,স্পিড বোটও নয়। খানিক বাদে তিনি আরও একটু এগিয়ে এলেন। আমার মেয়েও তার বিশাল ক্যামেরাতে পটাপট ছবি তুলতে লাগলো। এইবার তিনি, মানে দূরের বস্তুটি অনেটাই সামনে এসে গেছেন,দেখতে খুব পুরনো দুর্গের মত। তারপর বাড়িঘর ছোটবড় নানা রকমের। ভূগোলে দেখা নাম পুয়ার্তো রিকো এখন আমার চোখের সামনে। বিশাল জায়গা নিয়ে তিনি বসে আছেন মহাসমুদ্র আটলান্টিক-এর মাঝখানে। কী আশ্চর্য!
জাহাজ থেকে নেমে একটা বাসে উঠলাম। ড্রাইভারটি ভালো গাইডও। আমার মেয়ে তাকে অনুরোধ করলো একটু পুরনো শহরটিতে নিয়ে যাবার জন্য। এখানে রাস্তার পাশে প্রচুর গাছ,বিশেষ করে তাল গাছ, যতদূর যাচ্ছি তত দূরই গাছ। দুধারে বিশাল বিশাল বাড়ি। বিরাট অফিস, খুবই আধুনিক। ভাবতেই পারছিলাম না একটা দ্বীপ, যার চারদিক আটলান্টিকে-এ ঘেরা, সেখানে এতলোক থাকে? কেন থাকে? কী জানি, নিশ্চয় ভালোলাগে, তাই। খানিকটা এসে গাড়ি থামল। এবার আমরা দুর্গ দেখব। বিরাট ফোর্ট, এখন প্রায় ভগ্নদশা। সমুদ্রের গায়ে গা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশ্চর্য লাগলো দুর্গের ভেতরে কোনো গাছ না দেখে। অতবড় বিশাল জায়গায় একটাও গাছ নেই। শুনলাম বাইরে থেকে শত্রু এসে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে আক্রমণ করত, কাউকে দেখা যেতনা তাই সব গাছ কেটে ফেলা হলো যাতে শত্রুকে পরিস্কার দেখা যায় - এই হলো বৃত্তান্ত। গাছ না থাকার রহস্য পরিস্কার।
এবার আবার জাহাজে ফেরার পালা। ফেরার পথে দেখলাম গতবছরে ঘটে যাওয়া 'স্যান্ডি'-র তান্ডব লীলা। সমুদ্রের কাছাকাছি কোন বাড়িরই চিহ্ন নেই। একেবারে ছন্নছাড়া অবস্থা, কিন্তু কিছু জায়গায় বেশ তৎপরতার সঙ্গে নতুন বাড়ি ঘর তৈরী হয়ে গেছে। কত,কত বছরের পুরনো দ্বীপ কেমন ছোটখাটো শহর হয়ে উঠেছে। ভালো লাগলো না বলে বলা উচিত রোমাঞ্চ হলো। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে বনানীদি প্লেন-এ উঠতে ভয় পায়। জল দেখলে ভয় পায়, সে সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে এখানে কী করছে? কী জানি!
বাস থেকে নেমেই মনে হলো এবার কিছু খাওয়া দরকার। কিন্তু রাস্তায় এত ভিড়, খাবার জায়গাই দেখতে পাচ্ছিলাম না। ড্রাইভারটি বলেছিল, আজ এখানে মেলা বসেছে। সত্যিই মেলা। চারদিকে অনেক রকমের স্টল বসেছে, ঠিক আমাদের দেখা মেলার মত। রাস্তার মাঝখানে বেঞ্চ, চেয়ার দিয়ে খাবার জায়গা, সেখানে লোকেরা খাচ্ছে। আমরা সেখানে না খেয়ে একটা রেস্তোঁরাতে ঢুকলাম। খাবারের অর্ডার দিয়ে বসে আছি তো বসেই আছি, খাবার আর দেয়না। মেয়ে জামাই নাতি তিনজনেই খুব চটে গিয়ে মুখ লাল করে বসে রইলো। যখন উঠে পড়ব মনে করছি,তখনই খাবার এলো। কিন্তু রেগে রেগে কি আর খাওয়া যায়? কোনরকমে খেয়ে চলে এলাম। বাইরে তখন মেলা জমজমাট। আমরাও কিছু কিনব ভাবলাম কিন্তু বড্ড ভিড়। তাই আর ও পথে গেলামনা। কিন্তু দেখতে খুব ভালো লাগছিল। এখানকার লোকেরা খুব হাসিখুশি,আনন্দময় বলে মনে হলো। অন্ধকার হয়ে গেছে। দূর থেকে আলো ঝলমল জাহাজটাকে দেখে এত সুন্দর লাগছিল যে বলে বোঝাতে পারবনা। এবার আটলান্টিকে তার ছায়া দেখে একবারও ভয় পেলামনা,একবারও মনে হলনা জাহাজটা মহাসমুদ্রে ভাসছে। আজকের এই অভিজ্ঞতা,পুয়ার্তো রিকোতে কিছুসময়ের জন্যে দ্বীপবাসিনী হয়ে যাওয়া, চিরদিন মনে থাকবে।
আজ ৯ ই আগস্ট ২০১৩। আজ আবার অন্য আর একটা আইল্যান্ড-এ যাব। এই দ্বীপের নাম সেন্ট থমাস, দ্য ভার্জিন আইল্যান্ড। নামের তো কায়দা অনেক, তবে কী দেখব, সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। তাছাড়া এনার আরেকটি নামও আছে – শপিং ক্যাপিটাল - সেটাই তো মাথা খারাপ করার পক্ষে যথেষ্ট। সবাই খুব খুশি।
বেলা বাড়তেই তেনাকে একটু একটু দেখা যেতে লাগলো। প্রথমে একটু, তারপর আর একটু, তারপর আরও অনেকটা জায়গা জুড়ে বসে আছেন সেন্ট থমাস। আমার তো দূর থেকে দেখে মনে হলো পুয়ার্তো রিকোর থেকে আরও বড়। দূরের থেকে কাছে আসতেই দেখা গেল সেখানে অনেক গাড়ি চলাচল করছে। মানে ব্যাপারটা মোটেই গ্রাম গ্রাম নয়, বেশ ভালোই শহর শহর ছাপ। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম কখন থমাস বাবু আমাদের একদম কাছে এসে যান। অবশেষে তিনি একেবারে জাহাজের পাশে এসে গেলেন। অবাক হয়ে ভাবছিলাম চারিদিকে অতলান্তিক মহাসাগর দিয়ে ঘেরা যে দ্বীপ, যেখানে সবসময়েই সমুদ্রের ঝড়ে ভেসে যাবার সম্ভাবনা,সেখানে মানুষ কোন ভরসায়,কোন সাহসে জনবসতি গড়ে তোলে? এখানকার 'ক্যাথেরিন' আর 'স্যান্ডি'-র দাপট তো দেখলাম, তা সত্বেও!?
জাহাজ থেকে নেমেই একটা ছোটখাটো বাসে উঠলাম। শুনলাম শহর দেখে তারপর আমরা সমুদ্র সৈকতে যাব। বাস ড্রাইভারের অবস্থাটা একটু টলোমলো। তাই বাসটাও টলোমলো। চালকের নাম ববি। আমার মনে একটাই গান - 'ববি খো যায়'! এই ববির যা অবস্থা তাতে সত্যি সত্যি হারাবে না তো? সে মাইক্রোফোনে কী বলছে সেটা সেই বুঝতে পারছে, যাত্রীরা নয়। আমরা নিজেরাই বুঝতে চেষ্টা করলাম আমরা কী দেখছি!
খুব সরু রাস্তা। একপাশে পাহাড় আর আরেক পাশে সমুদ্র। খুবই মনোরম দৃশ্য। বাড়িগুলো অনেকটা পুরনো দার্জিলিং-এর মত। এরকম সরু রাস্তায় বেশিরভাগই দেখেছি একপাশে জঙ্গল আর আরেক পাশে গভীর খাদ,এখানে সেটা নয়। যাক্, অন্তত ববি আমাদের খাদে ফেলবেনা এইটা ভেবে নিশ্চিন্ত হলাম। একে খুব সরু রাস্তা,তার ওপর একবার সোজা একমিনিটে ওপর থেকে নীচে। আবার নীচে থেকে ওপরে। বাবারে,প্রায় যায় আর কী। যাই হোক,দৃশ্য দেখা শেষ,ববি আমাদের সৈকতে নাবিয়ে দিল। ব্যস,আমারও বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে গেল,কারণ আমার মেয়ে আর নাতি সমুদ্র স্নান করবে। কিন্তু ঝামেলা হলো যে সুইমিং কস্টিউম আনা হয়নি। সমুদ্রে এসে স্নান করবনা, এর চেয়ে বড় পাপ আর হয়না (আমার মেয়ের মতে), তাই জোর করে দোকান খুলিয়ে এযুগের মাতঙ্গিনী স্নান বস্ত্র ক্রয় করিলেন। আমি আর জামাই চুপচাপ গিয়ে ডেকচেয়ারে বসে পড়লাম।
ঘন্টা দেড়েক বাদে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মা ছেলেকে জল থেকে উঠতে হলো। আবার ববির বাস। এবার চালক আর একটু টলোমলো। তবুও উঠতেই হলো। শহরে এসে সবাই বাস থেকে নামলাম। হঠাৎ মনে হলো আমরা তো আজ ম্যাজিক আইস দেখব। কোথায় সীতা, কোথায় সীতার মত কোথায় ম্যাজিক আইস, কোথায় ম্যাজিক আইস বলতে বলতে আমরা অবশেষে পৌঁছলাম সেখানে। শুনলাম ওই বাড়িটার ভেতর একটি ঘর পুরোপুরি বরফ দিয়ে তৈরি। ভয় পাচ্ছিলাম ঠিকই। কিন্তু দেখতে ইচ্ছেও করছিল। সবাইকে এস্কিমোদের ড্রেস পরতে হবে। পরলাম। ঠিক যেন ভূগোলে পড়া এস্কিমো। সর্ব অঙ্গ ঢাকা, শুধু মুখমন্ডল দৃশ্যমান। ঢুকলাম সেই ঘরে। বাপরে,চারিদিক শুধুই বরফ,দেয়াল ছাদ সব। তার ভেতরে নানা রকম মূর্তি, গাছ পালা,বাড়ি ঘর,রাজা রানি এমনকি যিশু পর্যন্ত আছেন বরফে ঢেকে। সত্যি খুব ভালো লাগলো।
বাইরে বেড়িয়ে মনে হলো এবার খাওয়া দরকার। এখানে প্রচুর গয়নার দোকান। সেখানে যাওয়া হলো। আমার এগারো বছরের নাতি আমায় একটা হার কিনে দিল। আমার পাওয়া সেরা উপহার। দূর থেকে জাহাজটাকে দেখা যাচ্ছিল,আমি ভাবলাম বাপরে,ওই অত বড় জাহাজে চেপে আমরা এসেছি? আবার ভয়,আবার বনানীদির বুক ঢিপ ঢিপ শুরু হয়ে গেল। জাহাজের থেকে চোখ সরিয়ে খাবারের দোকান খুঁজতে লাগলাম। সবাই একবাক্যে একটি নাম বলল গ্ল্যাডিস কাফে। চললাম সেখানে। দোকানের মালিক এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা,তিনিই গ্ল্যাডি। সবাই মহিলা,সকলেই ওখানকার লোক,একটু পুরনো ধরনের রেস্তোরা। পুরনো গান বাজছে - ন্যাট কিং কোল-এর গান। আমার মন খারাপ করতে লাগলো। আমাদের ছোটবেলার গান,আমাদের বাড়িতে এই সব রেকর্ড ছিল। খাব কী, আমারতো তখন চোখে জল। মালকিন গ্ল্যাডিও সঙ্গে সঙ্গে গাইতে লাগলো। নিজের খুশিতে,মনের আনন্দে। খাওয়া সেরে জাহাজের দিকে পা বাড়ালাম,দেখে মনে হচ্ছিল কাছে,কিন্তু তা নয়,অনেকটা ঘুরে যেতে হবে। বুড়ি বনানীদির পক্ষে সেটা খুব সহজ হবেনা,অতএব ট্যাক্সি ধরা হলো। আবার জাহাজ।
রাত্তিরে আবার হলে খেতে যাওয়া। ইন্দোনেশিয়ান ইমাদে যে কী করে আমাদের চারজনের নাম পটাপট বলছে,ভাবতে অবাক লাগছে। একটা ভারী সুন্দর অল্পবয়সী ছেলে আছে, তার নাম দেবা,যখন মিষ্টি করে আমায় নমস্তে বলে, তখন কী যে ভালো লাগে। রাত সাড়ে ন' টায় রোজ নাচ-গান হয়, ইন্দোনেশিয়ান ভাষায়,আমার মেয়েও ওদের সঙ্গে নাচে। ওরা খুব উপভোগ করে। এখানে এখন আমার জন্যে স্পেশাল ইন্ডিয়ান নন ভেজ খাবার আসছে, সবই আছে শুধু পোস্তটা নেই, তাহলেই সর্বাঙ্গ সুন্দর হত। এবার ঘরে ফেরা। উঠতে গিয়ে মনে হলো, আচ্ছা? জাহাজটা কি দুলে উঠলো? ওঃ ভগবান, যত ভাবি ওসব ভাববনা, ততই ভাবনারা আমাকে ভাবায়। আর পারিনা। টাইটানিক ছবিটা কি না করলে চলছিলনা?
দশই অগাস্ট, ২০১৩ - আজ আবার আর একটা আইল্যান্ড-এ যাব, গ্র্যান্ড তুর্ক। বাবা, এত বার দ্বীপ দেখারই বা কী আছে! বেশ তো ভালোই আছি আয়েশ করে জাহাজে, শুধু শুধু দ্বীপবাসিনী হবার কি দরকার? কিন্তু আমিতো কলকাতার বনানীদি, সেখানে আমার কথা সবাই শুনবে। আর এখানে? থাক,ওসব কথার কোনো দরকার নেই।
আজ আর কোনো গাড়িতে চাপতে হলনা। জাহাজের লাগোয়াই সৈকত। ছোটখাটো জায়গা। চারদিকে পাম গাছ। বেশ মনোরম। মেয়ে আর নাতি তরতর করে জলে নেমে গেল আর আমরা দুজন যথারীতি ডেক চেয়ারে শুয়ে পড়লাম। কারণ আমরা তো আর জলপথের লোক নই। আর একটু পরেই তেনারা জল ছেড়ে উঠে পড়লেন কারণ আজ আরও দারুণ কিছু ঘটার কথা। ওনারা আজ ঘোড়ার পিঠে চেপে সমুদ্রে নামবেন। ঘোড়াগুলোর কথা ভেবে খুব খারাপ লাগলো। বেচারা। কিছু বলতে পারবেনা। আমারই মত অবস্থা আর কী! প্রথমে ঠিক ছিল আমি আর জামাই জাহাজে থাকব, ওরা মা আর ছেলে ঘোড়ায় চেপে সমুদ্রে নামবে। আমার তো মহা আনন্দ। আমায় যেতে হচ্ছেনা, ওই ভয়ঙ্কর দৃশ্যও দেখতে হবেনা। কিন্তু কী করে সব বদলে গেল জানিনা। শেষপর্যন্ত আমাদেরকেও যেতে হলো প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও।
গাড়ি চলল। খুব যে কিছু দেখার আছে তা নয়। বেশিরভাগটাই জল। আর গাছপালা। মাঝে মাঝে ছোট ছোট বাড়ি। ছোটখাটো অফিস। লোকজন কিছু দেখলামনা। গাড়িতে মোট দশ জন লোক। সবাই ঘোড়ায় চাপবে। চারদিকে শুধুই জল, ঘন নীল,কোথাও সরু হয়ে গেছে,আবার কোথাও বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে। বেশ খানিকটা পথ যাবার পর হঠাৎ সবাই বেশ খুশি খুশি ভাব দেখাতে লাগলো। বুঝলাম আচমকা ভেসে আসা আস্তাবলের গন্ধে ওরা এত আনন্দিত। দেখতে পেলাম বালির ওপর কয়েকটা ঘোড়া চেন দিয়ে বাঁধা আছে। যারা ঘোড়ায় চাপবে,তারা চটপট ছুটল সেই দিকে। সবাই সুইমিং কস্টিউম পরেই ছিল তার ওপর গাইডরা একটা লাল মত ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিল কোমরে। সকলের সঙ্গে আমার নাতি তিতাস আমাকে হাসিমুখে বাই দিদান বলে মাকে নিয়ে ছুটে জলের দিকে চলে গেল আর জামাই ছুটল ক্যামেরা হাতে ওদের পেছন পেছন। আর আমি ? বাবাগো বলে বুকে হাত দিয়ে ওদের দিকে পেছন ফিরে চেয়ারে বসে পরলাম। ভগবান আর কত পরীক্ষা নেবে?
চোখ বন্ধ করে বসেই আছি,ততক্ষণে এনারা গাইড-এর সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে নিয়েছেন। বিশেষ করে আমার নাতি, তিনি আবার হর্স রাইডিং জানেন, তাই তিনি কেরামতি দেখাতে আবারও জলে নামলেন গাইডের সঙ্গে। এবার আমার চিন্তা শুরু হলো ওর মা সঙ্গে নেই বলে। কিন্তু আমার তো জটায়ুর মত 'কোনো প্রশ্ন নয়' বলে বসে থাকতে হচ্ছে। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই শুনলাম সবাই হাততালি দিছে। বুঝলাম আমার সবেধন নীলমণি নাতি শ্রীমান তিতাস যুদ্ধ জয় করে ফেরত এলেন। কী হাসি বাবা আর মায়ের। আর আমি একবারটি চোখ খুলে দেখেই আবার চোখ বন্ধ করলাম। খুব নরম করে জিজ্ঞেস করলাম এবার কি যাবি?
মনে হলো মেয়ে মনে মনে বলছে-- কী বনানীদি, কেমন জব্দ?
এগারোই অগাস্ট,আর কোনো জায়গায় যাওয়া নয়,শুধু জাহাজে থাকো,খাও দাও আনন্দ কর। শপিংও কর ইচ্ছে মত। লোকেরা লাইন দিয়ে জিনিস কিনছে,হট টাবে বসে থাকছে ঘন্টার পর ঘন্টা,চারদিক জমজমাট। কত রকমের ভাষা। কত রকমের মানুষ। ওদের মন খারাপ,সন্তোষ দত্তর মত 'ছুটি ছুটি' বলে আনন্দ করতে পারছেনা। আর একদিন, তারপর ছুটি শেষ। আমার এই কয়েক দিনে অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা হলো। জলকে ভয় পাই ঠিক, কিন্তু যখন ব্যালকনিতে গিয়ে সমুদ্র দেখছি, তখন আর একটুও ভয় করছিলনা। ওই বিশাল জলরাশি, কিন্তু কী দারুণ গম্ভীর, দারুণ রাজকীয় সহজেই মাথা নীচু হয়ে যায়। প্রণাম করতে ইচ্ছে হয়। বলতে ইচ্ছে করে –'ধন্য হলো,ধন্য হলো মানব জীবন'।
বিকেলে ম্যাজিক শো দেখলাম। রোজই খাবার সময় দেখেছি লোকটি এ টেবিল ও টেবিলে ম্যাজিক দেখাচ্ছে। কিন্তু এখন একটা পুরোদস্তুর ম্যাজিক শো হলো। ম্যাজিশিয়ান উড়িষ্যার লোক,ভালো বাংলা বলে। বেশ ভাব হয়ে গেছিল আমাদের সঙ্গে। বিশেষ করে আমার নাতির সঙ্গে তো খুবই ভাব হয়েছিল। কী অদ্ভুত জীবন – ছ' মাসের জন্যে সব কিছু ছেড়ে শুধু জলের ওপর থাকা।
বারোই অগাস্ট। বন্দরের কাল হলো শেষ। এবার ভিড়াও তরী। আবার সুটকেশ গোছাও জিনিসপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে নাও। যত পর খেয়ে নাও মনের সুখে। কোথায় একটা গয়না বিক্রি হচ্ছে, ব্যস, ছোটো সেখানে, অনেক গয়না কেনা হলো। কেনা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মনটা ঠিক নেই, রাত পোহালেই বাড়ি যাবার তাড়া।
রাত্রে ডাইনিং রুমে সবাইকে দেখে খুব মন খারাপ করতে লাগলো। আমার মেয়ে বহু কষ্টে কান্না সামলালো। ওদের সবার মুখগুলো এই আট দিনে খুবই পরিচিত হয়ে গেছিল। কে জানে আবার কখনো দেখা হবে কীনা, সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে এলাম, এই কটা দিন কেমন করে কেটে গেল বুঝতেই পারা গেলনা। মনে মনে সবাইকে বললাম 'তোমাদের ভালো হোক'।
বাই বাই কার্নিভাল স্প্লেনডর...উই উইল মিস ইউ...

~ পুয়ের্তো রিকো, সেন্ট থমাস ও গ্র্যান্ড তুর্ক আইল্যান্ড ক্রুজের আরো ছবি ~

বনানী মুখোপাধ্যায় একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় শ্রুতি নাট্যকার। মধুসংলাপী নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্যের কন্যা হওয়ার জন্য শিশুকাল থেকেই নাটকের পরিবেশে মানুষ হওয়া। ইচ্ছে ছিল মঞ্চ অভিনেত্রী হওয়ার, কিন্তু হলেন নাট্যকার। হয়তো বিধাতার তাই ইচ্ছে ছিল। এই প্রথম ভ্রমন কাহিনি লেখা বনানীর।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher