উত্তর ও পশ্চিমে নর্থ সি, দক্ষিণে বেলজিয়াম এবং পূর্বে জার্মানি -এই হল নেদারল্যান্ডসের ভৌগোলিক অবস্থান। ইউরোলাইন্স (Eurolines) পরিচালিত কোচ সার্ভিসের সৌজন্যে ইউরোপের বিভিন্ন শহর থেকে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী “আমস্টারডাম” (Amsterdam)-এ আসা যায়। “শিফোল এয়ারপোর্ট” (Schiphol Airport) আমস্টারডামের প্রধান এবং ইউরোপের পঞ্চম বৃহত্তম বিমানবন্দর। ইউরোপের নানান জায়গা থেকে উড়ানেও শিফোল-এ পৌঁছে নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন শহরগুলি ভ্রমণ করা যায়।
আমস্টারডাম(Amsterdam)- নেদারল্যান্ডসের রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর। এই শহরের নামকরণ হয়েছিল “আমস্টেলরেডাম” (Amstelredamme) শব্দ থেকে -যার অর্থ “আমস্টেল” (Amstel) নদীর উপর তৈরি করা। আমস্টারডাম শহরে দেখা যায় সর্বধর্মের এক বিচিত্র সমণ্বয়। দ্রষ্টব্য স্থানগুলির মধ্যে রয়েছেঃ-
আমস্টারডাম ক্যানাল (Amsterdam Canal) – ইতালির ভেনিসের মতই আমস্টারডাম-ও ক্যানাল দিয়ে ঘেরা –ক্যানালগুলো গিয়ে পড়েছে নর্থ সি-তে। একশো কিলোমিটারেরও বেশি ক্যানেল, নব্বইটি দ্বীপ এবং পনেরশোটি ব্রিজ - ‘ভেনিস অব দ্য নর্থ’ – আমস্টারডামের আকর্ষণ। আমস্টারডামের ঐতিহাসিক ক্যানাল ক্রুজ (Canal Cruise) এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
রিক্স মিউজিয়াম (Rijks Museum)- এখানে রাখা আছে রেমব্রান্ড্টের বিশ্ববিখ্যাত ছবি “নাইটওয়াচ” (Nightwatch)। এছাড়া শিল্পীর আঁকা বহু ছবি সংরক্ষিত আছে এই মিউজিয়ামে। যে কোন পর্যটকের অভিজ্ঞতার ঝুলি অপূর্ণ থেকে যায় এখানে সময় অতিবাহিত না করলে। রেমব্রান্ডট্ ছাড়াও আছে বহু বিশিষ্ট ডাচ্ শিল্পীর আঁকা ছবি। “ক্লাসিকাল ডাচ্ আর্ট” (Classical Dutch Art)-এর প্রচুর নিদর্শনও দেখা যাবে এখানে। পুরোপুরি দেখতে গেলে হাতে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে যেতে হবে। একদিনে সব ছবির নাগাল পাওয়া বেশ কষ্টকর ব্যাপার।
ভ্যানগগের মিউজিয়াম (Van Gogh’s Museum)- ভ্যান গগের জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে আঁকা অসাধারণ সব ছবির সংগ্রহ রয়েছে এখানে। ‘দ্য পটেটো ইটারস’, ‘বেডরুম ইন আরলেস’, ‘দ্য ইয়েলো হাউস’, ‘স্টিল লাইফঃ ভাস উইথ টুয়েলভ সানফ্লাওয়ারস’, শিল্পীর ন’টি আত্মপ্রতিকৃতি এবং তাঁর একেবারে প্রথম দিককার আঁকা কিছু ছবি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সংগ্রহালয়টিতে ভ্যান গগের ছবির পাশাপাশি তাঁর সমসাময়িক ইমপ্রেসানিস্ট এবং পোস্ট ইমপ্রেসানিস্ট ধারার শিল্পীদের উল্লেখযোগ্য কাজের সংগ্রহও রয়েছে। এছাড়া ঊনবিংশ শতকের শিল্প –সংস্কৃতির বহু নিদর্শন এখানে রক্ষিত আছে।
স্টেডেলিক মিউজিয়াম(Stedelijk Museum)- ঐতিহ্যশালী এবং আধুনিক শিল্পকলার পীঠস্থান স্টেডেলিক মিউজিয়ামের সংগ্রহে রয়েছে বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর নানান শিল্পীদের কাজ।এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য পল সেঁজা, গেরিট রিটভেল্ট, অঁরি মাতিস, বারনেট নিউম্যান, পাবলো পিকাসো, অগাস্ত রঁদ্যা প্রমূখ।
অ্যান ফ্রাঙ্ক হাউস (Anne Frank House)- এইখানে আত্মগোপনকালেই ইহুদি কিশোরী অ্যান ফ্রাঙ্ক লিখছিলেন তাঁর দিনলিপি - পরে যা ‘ডায়েরি অফ অ্যান ফ্রাঙ্ক’ নামে বিশ্বখ্যাত হয়। বাড়িটি আমস্টারডামের কিছু দূরে অবস্থিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অত্যাচারী নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য ফ্রাঙ্ক ও পেলস পরিবারের মোট আটজন সদস্য দুবছর এই বাড়িটির এক গুপ্তকক্ষে লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি – সবাই ধরা পড়ে যান। অসুস্থ অবস্থায় কনশেনট্রেশন ক্যাম্পেই মৃত্যু হয় অ্যানের। যুদ্ধপরবর্তীকালে অটো ফ্রাঙ্কের প্রচেষ্টায় বাড়িটি মিউজিয়াম হিসেবে সংরক্ষিত হয়।
আমস্টারডাম স্কোয়্যার(Amsterdam Square)- শহরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত এই জায়গাটি পর্যটকদের কাছে পরিচিত “দ্য ডাম”(De Dam) নামে। আয়তক্ষেত্রাকার এই চত্ত্বরের পশ্চিমে পরপর রয়েছে রয়েল প্যালেস, মাদাম ত্যুসোর মিউজিয়াম, পনেরশো শতাব্দীর গথিক নিউ চার্চ। এর ঠিক উল্টোদিকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে গড়ে তোলা সাদা পাথরের ন্যাশনাল মনুমেন্ট। “দ্য ডাম” এর সাইড ওয়াকে খোলা আকাশের নীচে বা রঙিন ছাতার তলায় বসে শীতল বিয়ার পান -এক সুখকর অভিজ্ঞতা। এছাড়া স্কোয়্যার-এর ফুটপাথ ধরে, জামার পকেটে হাত গুঁজে আপনমনে হাঁটতেও বেশ ভালো লাগে।
আমস্টারডাম স্টক এক্সচেঞ্জ (Amsterdam Stock Exchange)- পৃথিবীর প্রাচীনতম স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে একটি এবং আমস্টারডাম শহরের প্রাণকেন্দ্র। ২০০০ সালে এটি ব্রাসেলস স্টক এক্সচেঞ্জ এবং প্যারিস স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইউরোনেক্সট (Euronext) গঠন করেছে।
আমস্টারডামের অন্যান্য আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে আমস্টারডাম মিউজিয়াম(Hermitage Amsterdam), রেডলাইট ডিস্ট্রিক্ট (Red light district), ক্যানাবিস কফিশপ (Cannabis Coffee Shops) প্রভৃতি।
মাদুরোডাম (Madurodam)- হেগ-এর স্কেভেনিঞ্জেনে অবস্থিত এই পার্কে সাজানো আছে নেদারল্যান্ডসের শহরের একটি মডেল – যা পর্যটকদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। শিফোল এয়ারপোর্ট, মডেল ট্রেন ও রেলস্টেশন, বন্দর, কৃষক নারী, ক্লগস্ পায়ে কৃষকের দল, দমকলবাহিনীর কর্মতৎপরতায় অগ্নি নির্বাপণ –সবেরই ক্ষুদ্র সংস্করণ সাজানো আছে এখানে। আছে একটি লোকাল সুভেন্যির শপ-ও।
ভলেনডাম (Volendam)- এক প্রাচীন ফিশিং ভিলেজ (Fishing village) বা মেছুয়াদের গ্রাম। আইজে নদীর তীরে শান্ত এই গ্রামের নিসর্গ বারবার আকর্ষণ করেছে পিকাসো, রেনোয়া-র মত শিল্পীদের। আমস্টারডাম থেকে ট্যুরিস্ট বাসে যেতে সময় লাগে ঘন্টা দু-তিন। সারাদিন কেটে যায় ঘুরে বেড়িয়ে, কেনাকাটা করে আর মাছ ভাজা খেয়ে। এদাম বন্দরের আশপাশে রয়েছে অনেক মাছভাজার স্টল। ধোঁয়া উঠতে থাকা মাছভাজার সঙ্গে পর্যটকদের উপরি পাওনা হয় ওলন্দাজদের আতিথেয়তা।
(তথ্য সহায়তাঃ মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়)
~ ভ্রমণ কাহিনি - ভলেনডাম – টুকরো গানের কলি ~