বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে শেয়ার করতে চান কাছের মানুষদের সাথে - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। ছয় থেকে ছেষট্টি আমরা সবাই এই ছুটির আড্ডার বন্ধু। লেখা ডাকে বা নির্দিষ্ট ফর্মে মেল করে পাঠালেই চলবে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com

 

প্রবারণা পূর্ণিমার রাতে

জিয়াউল হক শোভন

শহরের ভিতরে একটা উৎসবের আমেজ ছিলো। রাতের আকাশের দিকে হঠাৎ চোখ পড়তেই দেখি পুরো আকাশ রঙিন হয়ে আছে। উৎসের সন্ধানে আশপাশে খোঁজ করতেই আমরা পৌঁছে গেলাম কক্সবাজার এর সবচেয়ে বড় ক্যাং-এ। ক্যাং হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনাগার। স্যান্ডেল খুলে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। মন্দিরটি একটি টিলার উপর অবস্থিত। এলাকাটিও বেশ বড়। ভিতরে অনেকগুলো ছোট ছোট মন্দিরের সমাবেশ। সামনে বেশ বড় একটা খোলা জায়গা। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছিল। অনেক মানুষের সমাগম। একটু খেয়াল করতেই আকাশ রঙিন হওয়ার রহস্য খুঁজে পেলাম। অনেক মানুষ - ছেলে-বুড়ো, পুরুষ-মহিলা - ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সবাই মহানন্দে শত শত ফানুস ওড়াচ্ছে।

২০১১ সালে বান্দরবান অভিযান শেষ করে আমরা চলে যাই চকরিয়া আর্মি ক্যাম্প। রনি ভাইয়ের এক আত্মীয় সেখানকার আর্মি ক্যাপ্টেন ছিল। রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে আর্মির গাড়ি নিয়ে যাই ফাসিয়াখালি অভয়ারণ্য দেখতে। সেখান থেকে তার পরেরদিন সকালে রওনা দিই কক্সবাজারের দিকে। কক্সবাজার পোঁছেই সোজা চলে যাই সমুদ্র সৈকতে। সমুদ্রের ধারে কিছুক্ষণ কাটিয়ে, রাতে থাকার জন্য ঝাউবনে তাঁবু টাঙানোর জায়গা ঠিক করে করে খাওয়াদাওয়া সারতে ফিরে আসি শহরের ভিতরে। একটা জায়গায় দেখি ভ্যানের উপরে কাঁকড়া রান্না করে বিক্রি করছে। লোভ আর সামলাতে পারলাম না। পঞ্চাশ টাকা প্লেট কিন্তু স্বাদ অসাধারণ। তখনও আমরা জানতাম না যে সেদিন প্রবারণা পূর্ণিমার রাত। তারপরে হঠাৎই চোখে পড়ল আকাশজুড়ে ভেসে থাকা রঙিন রঙিন ফানুসগুলো।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে প্রবারণা পূর্ণিমা। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই উৎসব পালন করেন। স্বর্গ থেকে গৌতম বুদ্ধের আগমন উপলক্ষ্যেই মূলত এই দিনে অনুষ্ঠানটি পালন করা হয়। প্রবারণার তিন মাস আগে থেকে ভান্তেরা (বৌদ্ধ পুরোহিত) ক্যাং এর ভিতর স্বেচ্ছা নির্বাসন করেন। কক্সবাজারে মূলত রাখাইন সম্প্রদায় এই উৎসবটি অনেক বড় করে পালন করে। সাকরাইন,কঠিন চীবরদান, বিজু উৎসব, পানি খেলা ইত্যাদি জনপ্রিয় উৎসবের মতো প্রবারণা পূর্ণিমাও বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।

আমরাও বেশ উৎসাহেই যোগ দিলাম ফানুস ওড়ানোর ছোট একটি দলে। বড়বড় চুল, উষ্কখুষ্ক চেহারা, পিঠে ব্যাকপ্যাক, তাঁবু আর কোমরে স্যান্ডেল – এই অদ্ভুত মূর্তি দেখে অনেকেই আমাদের ফিরে ফিরে দেখছিলেন। উৎসবের ভিড়ে নিজেদের বেমানানও ঠেকছিল অবশ্য। এর মধ্যেই পরিচয় হলো এক রাখাইন পরিবারের সাথে। অনেকেই সপরিবারে উৎসবে এসেছেন ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গা থেকেও। ফানুস ওড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন রাখাইন গান হচ্ছিল। ভাষা না বুঝলেও সুরটা খুব ভালো লাগছিলো। পরিবেশটা ছিল খুবই সুন্দর।
রাখাইনরা অনেকেই মন্দিরে পুজো করছিলেন। বৌদ্ধমূর্তিকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। মন্দিরগুলোও উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছিল। সিঁড়ি দিয়ে সবচেয়ে ওপরের মন্দিরে চলে গেলাম। ভিড় আর কোলাহল দুইই এখানে কম। সমুদ্রের গর্জনও শোনা যাচ্ছিল। অনুষ্ঠান শেষ হোল প্রায় ১২ টার দিকে। ফানুস ওড়ানোও শেষ। সাগরের কোলে অনেক দূর পর্যন্ত আকাশে ভেসে যাচ্ছিল রঙিন ফানুসের দল।

সৈকতে ফিরে এসে তাঁবু টাঙালাম। একটু রাত হতেই নির্জন হয়ে গেলো বিস্তীর্ণ সাগরবেলা। তখনই দেখতে পেলাম সমুদ্রের আসল সৌন্দর্য। নির্জন সৈকতে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় হাঁটার কথা এতদিন গল্প উপন্যাসেই পড়েছিলাম, এবার নিজেরা অনুভব করলাম। পূর্ণিমার আলোয় সমুদ্রের অসামান্য রূপ উপভোগ করেই রাত্রি পার হয়ে গেলো। ভোরের আলো একটু ফুটতে একজন দুজন করে মাছ ধরা জেলেরা বের হলো। তাঁবুতে ফিরে আমাদের চোখেও ঘুম নেমে এল।

~ কক্সবাজারের তথ্য ~

 

 

ভ্রমণপ্রেমী জিয়াউলের স্বপ্ন সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে প্রকৃতি আর বিভিন্ন ধরনের মানুষের জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

অপরূপা সোমেশ্বরী

মার্জিয়া লিপি

সোমেশ্বরীর পাড়ে এসেই মনটা বাতাসে ভাসতে থাকে। নদী পাহাড়ের অপরূপ আরণ্যক সৌন্দর্যে বিমোহিত প্রকৃতি। মেঘ ঠেলে সূর্য়ের আলো এসে পড়েছে পাহাড়ে। স্নিগ্ধ নরম সোনালি রোদ। নদীর পাড়ে দাঁড়ালেই দেখা যায় ভারত সীমান্তের মেঘালয় রাজ্যের মেঘ ঢাকা গারো পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য। নদীর দুপাশে বিস্তীর্ণ বালুতট। সোমেশ্বরীর একপাড়ে দুর্গাপুর অন্যপাড়ে বিরিশিরি। সুসং রাজ্যের গারো সভাপতি দুর্গার নাম থেকে এই এলাকার নামকরণ হয়েছে আর সোমেশ্বরীর নাম হয়েছে রাজার পাঠক সোমেশ্বরের নাম থেকে।
আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক পটভূমি দুর্গাপুর। উনিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশ দশকে মহাজনদের অমানবিক নির্যাতনের প্রতিবাদে মণিসিংহের নেতৃত্বে এখানে সংগঠিত হয় আদিবাসীদের টংক বিরোধী আন্দোলন। সেসময়ে বিদ্রোহী আদিবাসীদের লাল রক্তে রঞ্জিত হয় সোমেশ্বরীর কাঁচের মত টলটলে নীল পানি। তাই এই নদীর সঙ্গে মিশে রয়েছে স্থানীয়দের বেদনার স্মৃতি।
পাড়ের কিনারায় এসে নৌকার অপেক্ষা। একপাশের বালুতটে সারাইয়ের অপেক্ষায় পড়ে আছে মাঝারি একটি নৌকা। খরস্রোতা সোমেশ্বরী। পাহাড়ের বরফ গলা স্বচ্ছ,শীতল ধারা। নদীর স্বচ্ছ পানির নীচে ছোটবড় পাথর,নুড়ি ভেসে চলছে। মহাশোল মাছের আবাসস্থল এই সোমেশ্বরী নদী। টলমলে পানির নীচে পাথরের গায়ের সবুজ শৈবাল খেয়ে বেঁচে থাকে মহাশোল মাছ। শিল্পীর প্রোর্ট্রেটে আঁকা নীল রঙের সোমেশ্বরী। দূরে সবুজ পাহাড়,সাদা আসমানি নীল রঙের মিশেল আকাশে হেলান দিয়ে আছে। দেখে মনে হয়,যেন আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায়। সাদা মেঘগুলো পাহাড়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। নদীর একপাশ শীর্ণ। পায়ে হেঁটেই পাড় হলাম পাহাড়ি এই দস্যি নদী। বহু বছরের টগবগে যৌবন আজ অনেকটাই স্তিমিত। অবশ্য আষাঢ়-শ্রাবণে তীব্র জলজ উচ্ছ্বাস এসে ভরিয়ে দেয় সোমেশ্বরীকে,তখন তার অন্যরকম ভয়ঙ্কর রূপ। এক পাশে বিস্তীর্ণ বালুচর অন্যপাশে সোমেশ্বরী নদী সাপের গতিতে এঁকেবেঁকে বয়ে চলছে। ধু ধু বালু রোদে ঝিকমিক করছে। বিজয়পুর সীমান্তে ফাঁড়ির দিকে গন্তব্য, রিকসা চড়ে ১৯ জনের দল। ২-৩ জন করে বেশ কয়েকটি রিকসায় পাড়ি দিচ্ছি গ্রামের পথ। আঁকা বাকাঁ রাস্তা, বাঁশের ঝাড়, কোথাও ধানক্ষেত। রাস্তার মোড়ে বাঁশের টং-এ পান, বিড়ি, চা-এর বেসাতি।
কাছেই রাণিখং গির্জা। মা মেরীর আর যিশুর ছবির পাশেই পাথরে খোদাই করা আছে গির্জার ইতিহাস। প্রায় ১১০ বছরের পুরোনো এই গির্জা দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের টিলার ওপরে। রিকসা থেকে নেমে তানজিলের ক্যামেরায় গির্জায় মা মেরী আর যিশুর সাথে বিভিন্ন ভঙ্গিতে একের পর এক ছবি তুলে চলেছে দলের প্রায় সকলেই। বিস্ময় জাগে, এত অজগাঁয়ে শতবছরের পুরোনো ইট সিমেন্ট আর পাথরের স্মৃতি চিহ্ন দেখে।
সীমান্তে বিজয়পুর ফাঁড়ি যেখানে সাদা মাটি পাওয়া যায় সেদিকে আমরা এগিয়ে যাচিছ। পথের একপাশে লাল শাপলার শীতল স্নিগ্ধ পুকুর, পাড়ে নারকেল গাছের সারি। গারো পাহাড় ছাড়িয়ে আমরা চিনামাটির পাহাড়ের দেশে পৌঁছেছি। খানিক কাঁচা, খানিক পাকা রাস্তা, কখনও বাঁশঝাড়ের মাঝখান দিয়ে মাটির সরু পথ পেরিয়ে প্রায় আধঘন্টার রাস্তা শেষে দৃষ্টিসীমায় এবার সাদামাটির পাহাড়। শ্রমিকরা মাটি তুলছে - হালকা বিভিন্ন রঙের মিশেল মাটি আর তার থেকে আলাদা করে রাখছে সাদামাটি। কিছু মাটি কাগজে মুড়ে সুভ্যেনির হিসেবে ব্যাগে রেখে এগিয়ে চলি স্থানীয় পুটিমারী বাজারে। পাশেই একটি সেমিনারি যেখানে খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী ফাদারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
ফিরে আসার তাড়া। তবে ফেরার আগে বাজারে সেরে নিলাম দেশি মুরগির ঝাল ঝোলে দুপুরের খাবার।

~ সোমেশ্বরীর তথ্য || সোমেশ্বরীর আরো ছবি ~

লেখিকা ও পরিবেশবিদ মার্জিয়া বাংলাদেশের জাতীয় স্তরে পরিবেশ পরামর্শক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে কর্মরত রয়েছেন। কাজের সূত্রে এবং ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের আনাচেকানাচে। প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ নিয়ে সেই অনুভূতির ছোঁয়াই ফুটে উঠেছে তাঁর কলমে। প্রকাশিত বই 'আমার মেয়েঃ আত্মজার সাথে কথোপকথন'।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

জোনাকি পোকার দেশে

রফিকুল ইসলাম সাগর

ঈদের দু'দিন পর মনে হচ্ছিল কোথাও যাওয়া প্রয়োজন। তা না হলে ঈদই হবে না। আমার মন ঢাকায় আর এক মুহূর্তও থাকতে চাইছে না। মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে কোথায় যাওয়া যায় তার চিন্তা। রাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসে সিদ্ধান্ত হলো আমার ফুপুর বাড়ি যাব – হরিয়াবহ গ্রাম। দুপুর সাড়ে বারোটায় ট্রেন। সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে দশটা। দ্রুত বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়লাম। হাতে সময় খুব কম। এরই মধ্যে বন্ধুরা সবাই স্টেশনে পৌঁছে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। এদিকে তাড়াহুড়া, ওদিকে নির্বিকার রিক্সাচালক রিক্সা রাস্তার এক পাশে থামিয়ে একেকবার মোবাইল ফোনে কথা বলেই চলেছে। মহাখালী পর্যন্ত রিক্সায় গিয়ে তারপরে বাসে উঠলাম। ঈদের ছুটিতে ঢাকার পথ পুরো ফাঁকা ছিল। পথে গাড়ি আর মানুষ দুইয়েরই সংখ্যা বেশ কম। অন্য দিনের মত বাসের ভিতরে যাত্রীর চাপ নেই। খুব আরামেই অল্প সময়ে স্টেশনে পৌঁছালাম। মনে মনে ভাবলাম আমাদের ঢাকার রাস্তা যদি সব সময় এমন ফাঁকা থাকত।
আমি পৌঁছানোর পর বন্ধুরা নিশ্চিন্ত হলো। এবার ট্রেন আসার অপেক্ষা। ঠিক টাইম মত সাড়ে বারোটাতেই স্টেশনে ট্রেন এসেছে। ব্যাপারটা আমাদের অবাক করল। টাইম মত ট্রেন আসা তো বিশাল বড় ভাগ্যের ব্যাপার। খুশি মনে উঠে পড়লাম ট্রেনে, চলতেও শুরু করল। গন্তব্য আজমপুর। ঘোড়াশাল স্টেশনে গিয়ে থামল ট্রেন। কী ব্যাপার এই স্টেশনে তো ট্রেন থামার কথা না, বলল মনিম। পর্যবেক্ষণ করতে ট্রেন থেকে নেমে জানতে পারি অপরপ্রান্ত থেকে আরেকটি ট্রেন আসছে। এভাবে জিনারদী, রায়পুরা ও আশুগঞ্জ মিলিয়ে চারবার ট্রেন থামল। আড়াই ঘন্টার পথ আজমপুর পৌছাতে সময় লাগলো সাড়ে তিন ঘন্টা। যাওয়ার পথে ট্রেন থেকে দেখা দৃশ্যগুলো খুব উপভোগ করেছি। ঘোড়াশাল ও ভৈরব দু'টি বড় ব্রিজ। রেলপথের দু'পাশের নদীগুলো বর্ষার পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ। ট্রেন থেকে নেমে খানিকটা হেঁটে একটি সিএনজি অটোরিক্সায় উঠে পড়লাম পাঁচ বন্ধুতে। গাড়ি চলল হরিয়াবহ গাঁয়ের পথের দিকে।
হরিয়াবহ বলতে গেলে একেবারে অজপাড়াগাঁ। বিবাড়ীয়া জেলার কসবা থানার ছোট্ট একটি গ্রাম, কিন্তু সৌন্দর্যে অপরূপ। পাশেই ভারতের সীমান্ত। হরিয়াবহ গ্রামে এখনও পুরোপুরি বিদ্যুৎ পৌছায়নি। সরাসরি কোনও বাস যায়না। সড়ক পথে ঢাকা থেকে যেতে অনেক সময় লাগে তাই রেলপথ ব্যবহার করে অধিকাংশ মানুষ। এখানকার বেশিরভাগ পুরুষ চাকুরিজীবী। কিছু পুরুষেরা চাকরির জন্য ঢাকা নয়তো চট্টগ্রামে থাকেন। কেউবা পাড়ি জমিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। আর বাকিরা গ্রামে কৃষি কাজ করেন। বলা যায় এই গ্রামে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যাই বেশি। পাহাড়ি এলাকা। হরিয়াবহ গ্রামের বিয়েতে এখনো পালকির প্রচলন রয়েছে। ইমামবাড়ি রেল স্টেশনের সামনে পালকি ভাড়া দেওয়া হয়। তবে দিনদিন পালকির কদর কমে যাচ্ছে। ছোটবেলায় অসংখ্য পালকি দেখতাম। তখন পালকি ছিল বিয়ের পর বউ নিয়ে যাওয়ার এক মাত্র মাধ্যম। এখন আর আগের মতো পালকি নেই।
চণ্ডিদার বাজার এসে অটো রিক্সা থামল। একে একে সবাই নেমে যার যার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বাজারের মানুষগুলো আমাদের দিকে কেমন যেন অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। ঢাকা থেকে কেউ এলে বাজারের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই তাকিয়ে থাকে। কেউ কেউ আমাদের প্রশ্ন করল আপনারা কোন বাড়িতে যাবেন? হরিয়াবহ গ্রামের পাশেই চণ্ডিদার সীমান্ত। চণ্ডিদার বাজারের ভেতর দিয়েই গ্রামে যাওয়ার পথ। পাশেই একটি প্রাইমারি স্কুল। অন্যপথে হাইস্কুল। প্রাইমারি স্কুলের পাশ দিয়ে গাঁয়ে যাওয়ার রাস্তায় ঢুকলাম। কখনও সবুজ ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে আঁকা-বাঁকা মাটির রাস্তা, কখনও পুকুরের পাশ দিয়ে। এভাবে অবশেষে পৌঁছলাম ফুফুর বাড়ি। খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বাজারের দিকে গেলাম। বাজারে এখন অনেক দোকান হয়েছে, সবকিছুই পাওয়া যায়। নতুন একটি হাসপাতাল হয়েছে। এখানের মিষ্টি খুবই সুস্বাদু। কিন্তু চায়ের দোকানে চা খেয়ে স্বাদ পাওয়া যায় না। 'বরা' আর মিষ্টি বিকেলের নাস্তা করলাম। পিঁয়াজির মতো দেখতে ছোট ছোট তেলে ভাজা এক প্রকারের খাবার পাওয়া যায়, স্থানীয় নাম ‘বরা’, খেতে খুবই ভালো। ‘বরা’ বিক্রি হয় পাল্লা পাথর দিয়ে মেপে কেজি দরে। তারপর হাই স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকি। স্কুলটি অনেক বছরের পুরনো। হাঁটতে হাঁটতে একটু সামনে গিয়ে বড় একটি পুকুরের পাড়ে বসে খানিকক্ষণ মাছের লাফালাফি দেখলাম।
এখানের মূল আকর্ষণ হলো সন্ধা ঘনিয়ে আসলেই লক্ষ লক্ষ জোনাকি পোকা পুরো গ্রামটিকে আলোকিত করে তোলে। তখন একটি গান খুব মনে পরে ‘জোনাকির আলো নিভে আর জ্বলে শাল মহুয়ার বনে’। সত্যি, এই একটি দৃশ্য আমাকে বারবার এই গ্রামে টেনে আনে। বন্ধুরা সবাই খুব অবাক হয় এত সুন্দর দৃশ্য দেখতে পেয়ে। মনে পড়ে ছোট বেলায় এখানে বেড়াতে এলে জোনাকি পোকা ধরে বোতলের মধ্যে আটকিয়ে রাখতাম।
পরেরদিন সকালে নাস্তা সেরে আমরা গোসল করতে দারোগা বাড়ির পুকুর ঘাটে গেলাম। গ্রামের আরো অনেকেই এই পুকুর ঘাটে গোসল করতে এসেছে। দীর্ঘ সময় পুকুরে ডুব দিলাম, ভেসে থাকলাম, সাঁতার কাটলাম। তারপর চন্ডিদার সীমান্তের পাহাড়ি এলাকায় বেড়াতে গেলাম। যাওয়ার পথে রাস্তার দু’পাশে অনেক কাঁঠাল গাছ চোখে পড়ল। বেশ উঁচু পাহাড়। সবগুলো পাহাড়ে কাঁঠালের বাগান। এ যেন কাঁঠালের দেশ। পাহাড়ের ওপর মাটির ঘরে মানুষের বসবাস।  ওপরে ওঠার জন্য সিঁড়ি কাটা আছে। দূর দুরান্তে দেখা যায় উঁচু উঁচু পাহাড়, বড় বড় গাছ। যার বেশির ভাগ অংশ ভারতের সীমান্তের ভিতরে। আশেপাশের গ্রামগুলো খুব শান্ত চারিদিকে সবুজ ধান ক্ষেত, শাক সবজির বাগান। 
সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকা ফেরার ট্রেন। পড়ন্ত বিকেলে গাঁয়ের সবুজ পরিবেশ চোখে নিয়ে আর বিশুদ্ধ বাতাস শরীরে লাগিয়ে অটো রিক্সায় চড়ে রেল স্টেশনের দিকে ফিরে চলা। গাছে গাছে পাখিদের কিচির মিচির। ফিরে যাচ্ছি বলে মনটা কেমন জানি আবেগী হয়ে গেল। ট্রেনে উঠলাম। তারপর আবার সেই ব্যস্ত শহর।

পেশায় সাংবাদিক রফিকুলের বাড়ি বাংলাদেশে। জাতীয় দৈনিক পত্রিকার ফান ম্যাগাজিনে রম্য লেখার মধ্য দিয়ে লেখালেখির শুরু। বর্তমানে অনলাইন ভিত্তিক কার্টুন ম্যাগাজিন টুনস ম্যাগ বাংলা সম্পাদনা সহ বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় নিয়মিত কলম ধরেন। পাশাপাশি যুক্ত রয়েছেন নানান সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে। ভ্রমণ, আড্ডা ও ছবি তোলা তাঁর পছন্দের বিষয়।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher